পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি . ৩১৫ আত্মীয়গৃহে বাল্যকাল হইতে পরের মতো লালিত হইয়াছিল বলিয়া, লোকসাধারণের নিকট আশার এক প্রকার আস্তরিক কুষ্ঠিতভাব ছিল । ভয় হইত, পাছে কেহ প্রত্যাখ্যান করে । বিনোদিনী যখন তাহার জোড়া ভুরু ও তীক্ষ দৃষ্টি, তাহার নিখুত মুখ ও নিটোল যৌবন লইয়া উপস্থিত হইল, তখন আশা অগ্রসর হইয়া তাহার পরিচয় লইতে সাহস করিল না । আশা দেখিল, শাশুড়ী রাজলক্ষ্মীর নিকট বিনোদিনীর কোনোপ্রকার সংকোচ নাই । রাজলক্ষ্মীও যেন আশাকে বিশেষ করিয়া দেখাইয়া দেখাইয়া বিনোদিনীকে বহুমান দিতেছেন, সময়ে-অসময়ে আশাকে বিশেষ করিয়া শুনাইয়া শুনাইয়া বিনোদিনীর প্রশংসাবাক্যে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছেন । আশা দেখিল, বিনোদিনী সর্বপ্রকার গৃহকর্ষে স্বনিপুণ,— প্রভুত্ব যেন তাহার পক্ষে নিতাস্ত সহজ স্বভাবসিদ্ধ— দাসদাসীদিগকে কর্মে নিয়োগ করিতে, ভৎসনা করিতে ও আদেশ করিতে সে লেশমাত্র কুষ্ঠিত নহে। এই সমস্ত দেখিয়া আশা বিনোদিনীর কাছে নিজেকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে করিল। সেই সর্বগুণশালিনী বিনোদিনী যখন অগ্রসর হইয়া আশার প্রণয় প্রার্থনা করিল, তখন সংকোচের বাধায় ঠেকিয়াই বালিকার আনন্দ আরো চার গুণ উছলিয়া পড়িল । জাদুকরের মায়াতরুর মতো তাহাদের প্রণয়বীজ এক দিনেই অঙ্কুরিত, পল্লবিত ও পুষ্পিত হইয়া উঠিল। আশা কহিল, “এস ভাই, তোমার সঙ্গে একটা কিছু পাতাই।” বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “কী পাতাইবে।” আশা গঙ্গাজল, বকুলফুল প্রভৃতি অনেকগুলি ভালো ভালো জিনিসের নাম করিল। বিনোদিনী কহিল, "ও-সব পুরানো হইয়া গেছে ; আদরের নামের আর यांनद्र मांझे !” আশা কহিল, “তোমার কোনটা পছন্দ ।” বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “চোখের বালি ।” শ্রুতিমধুর নামের দিকেই আশার ঝোক ছিল, কিন্তু বিনোদিনীর পরামর্শে আদরের গালটিই গ্রহণ করিল। বিনোদিনীর গলা ধরিয়া বলিল, “চোখের বালি ।” বলিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল ।