পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ - 8 ՖԳ করিয়া ব্রহ্মচর্যব্রতের অভিনয় সমাপনপূর্বক আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ বহুকাল হইতে দ্বিজত্ব প্রাপ্ত হইয়া আসিতেছেন। কোথায় বা গুরুগৃহে বাস, কোথায় বা বেদাধ্যয়ন, কোথায় বা কঠিন ব্ৰতাচরণ। অতএব প্রথমেই দেখা যাইতেছে, মহুসংহিতার মতে যে-মানুষ গঠিত হইত, এখনকার মতে সে-মানুষ গঠিত হয় না। দ্বিতীয়ত, মহু পুরুষের পক্ষে বিবাহর যে-বয়স নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, তাহাই বা কোথায় পালিত হইয়া থাকে। তৃতীয়ত, বিবাহের পরে মকু স্ত্রীপুরুষের পরস্পর সংসর্গের যে-সকল নিয়ম স্থির করিয়াছেন, তাহাই বা কয়জন লোক জানে ও পালন করে। তবে, আপন সুবিধামতো মচু হইতে দুই-একটা শ্লোক নির্বাচন করিয়া বর্তমান দেশাচারপ্রচলিত বিবাহপ্রথার পক্ষে প্রয়োগ করা সকল সময়ে সংগত বোধ হয় না। তবে যদি কেহ বলেন, আমাদের বর্তমান প্রথাসকল হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বিশুদ্ধতা হারাইয়াছে, অতএব আমরা মন্থকে আদর্শ করিয়াই আমাদের বিবাহ দিপ্রথার সংস্কার করিব, কারণ সেকালের বিবাহদি পবিত্র ও আধ্যাত্মিক ছিল, তবে আমার জিজ্ঞাস্য এই— বিবাহদি সম্বন্ধে মন্থর সমস্ত নিয়ম নির্বিচারে গ্রহণ করিবে, না আপনাপন মতানুসারে স্থানে স্থানে বর্জন করিয়া সংহিতাকে আপন স্থবিধা ও নূতন শিক্ষার অম্বুবতী করিয়া লইবে । মনুসংহিত স্ত্রীপুরুষের যে সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া দিয়াছেন তাহার সমস্তটাই পবিত্র ও আধ্যাত্মিক, ন তুমি তাহার মধ্য হইতে যেটুকু বাদসাদ দিয়া লইয়াছ সেইটুকু পবিত্র ও আধ্যাত্মিক ? আমরা যে শাস্ত্র হইতে বাদসাদ দিয়া কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দেশান্ডুরাগে কথঞ্চিৎ অন্ধ হইয়া আপন ঘরগড়া মতকে প্রাচীন বলিয়া প্রতিপন্ন করি, এখানে তাহার দুইএকটি উদাহরণ দিতে চাই । শ্রদ্ধাস্পদ শ্ৰীযুক্ত চন্দ্রনাথ বস্থ পরম ভাবুক জ্ঞানবান ও সহৃদয়। র্তাহার শকুন্তলাসমালোচন তাহার আশ্চর্য প্রতিভার পরিচয় দিয়াছে। আমি যতদূর জানি বাংলায় এরূপ গ্রন্থ আর নাই। বাংলার পাঠকসাধারণে চন্দ্রনাথবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। এইজন্য কিছুকাল হইল তিনি ‘হিন্দুপত্নী এবং ‘হিন্দুবিবাহের বয়স ও উদেশ্ব’ নামে যে-দুই প্রবন্ধ প্রচার করেন তাহ সাধারণ্যে অতিশয় আদৃত হইয়াছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি হিন্দুবিবাহের আধ্যাত্মিকতা ও হিন্দুদম্পতির একীকরণত সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহ আজকাল গুটিকতক কাগজে অবিশ্রান্ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে। ইনি উক্ত প্রবন্ধদ্বয়ে হিন্দুবিবাহ এবং তাহার আনুষঙ্গিকস্বরূপে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে যতটা বলিয়াছেন, র্তাহার পরবর্তী আর কেহ ততটা বলেন নাই। খ্যাতনামা গুণী ও গুণজ্ঞ লেখক শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার সরকার মহাশয় চন্দ্রনাথবাবুর বিবাহ প্রবন্ধের উল্লেখ করিয়া বলেন, “হিন্দুবিবাহের ওরূপ পরিষ্কাস ব্যাখ্যা আর কোথাও নাই।”