পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শবদতত্ত্ব ○br○ সেন মহাশয় তাহার কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার না করিয়া নবদ্বীপের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার করিয়াছেন । তাহার বিপরীত করিবার স্বাধীনতা তাহার ছিল ; কিন্তু নিশ্চয় কাব্যের ক্ষতি আশঙ্কা করিয়া সেই স্বাধীনতাস্থখ ভোগ করিতে ইচ্ছা করেন নাই। সকল দেশেই প্রাদেশিক প্রয়োগের বৈচিত্র্য আছে, তথাপি এক-একটি বিশেষ প্রদেশ ভাষাসম্বন্ধে অন্যান্য প্রদেশের উপর কর্তৃত্ব করিয়া থাকে। ইংরেজিভাষা লাটিননিয়মে আপনার বিশুদ্ধি রক্ষা করে না। যদি করিত, তবে এ ভাষা এত প্রবল, এত বিচিত্র, এত মহৎ হইত না । ভাষা সোনারুপার মতো জড়পদার্থ নহে যে, তাহাকে ছাচে ঢালিব । তাহা সজীব,— তাহ নিজের অনির্বচনীয় জীবনীশক্তির নিয়মে গ্রহণ ও বর্জন করিতে থাকে। সমাজে শাস্ত্র অপেক্ষ লোকাচারকে প্রাধান্য দেয়। লোকাচারের অসুবিধা অনেক, তাহাতে এক দেশের আচারকে অন্য দেশের আচার হইতে তফাত করিয়া দেয় ; তা হউক, তবু লোকাচারকে ঠেকাইবে কে। লোককে না মারিয়া ফেলিলে লোকাচারের নিত্য পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য কেহ দূর করিতে পারে না। কৃত্রিম গাছের সব শাখাই এক মাপের করা যায়, সজীব গাছের করা যায় না। ভাষারও লোকাচার শাস্ত্রের অপেক্ষা বড়ো । সেইজন্যই আমরা ‘ক্ষণস্ত’ দেওয়া বলিতে লজ্জা পাই না। সেইজন্যই ব্যাকরণ যেখানে "আবশ্ব্যকতা ব্যবহার করিতে বলে, আমরা সেখানে ‘আবশ্ব্যক ব্যবহার করি। ইহাতে সংস্কৃতব্যাকরণ যদি চোখ রাঙাইয়া আসে, লোকাচারের হুকুম দেখাইয়া আমরা তাহাকে উপেক্ষা করিতে পারি। একটা ছোটো কথা বলিয়া লই । ‘অমুবাদিত কথাটা বাংলায় চলিয়া গেছে— আজকাল পণ্ডিতেরা অনূদিত লিখিতে শুরু করিয়াছেন। ভয় হয় পাছে তাহারা স্বজন কথার জায়গায় ‘সর্জন চালাইয়৷ বসেন । সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় বঙ্গদর্শনসম্পাদক ‘শব্দদ্বৈত’ নামক এক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন । ১ ফাল্গুনমাসের প্রদীপে তাহার একটি সমালোচনা বাহির হইয়াছিল। শ্ৰীযুক্ত বিহারীলাল গোস্বামী সেই সমালোচনা অবলম্বন করিয়া উক্ত বিষয়ের আলোচনা করিয়াছেন। মূল প্রবন্ধলেখকের নিকট এই আলোচনা অত্যন্ত হৃদ্য । এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য পরিস্ফুট করিয়া বলিতে গেলে সংক্ষিপ্ত সমালোচনার সীমা লঙ্ঘন করিবে । কেবল একটা উদাহরণ লইয়া আমাদের বক্তব্যের আভাসমাত্র দিব।— আমরা ১ দ্রষ্টব্য রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ ৩৭১ ।