পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ৬২১ কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হাতে রাখিতেই হয়। দুই-শ জনকে যজ্ঞে নিমন্ত্ৰণ করিলে নূ্যনপক্ষে আড়াই-শ জনের মতো আয়োজন করিতে হয়। সমাজের সকল বিভাগে যখন এই বাড়তি ভাগ, এই ওরিজিন্তালিটি, এই প্রতিভা প্রত্যক্ষগোচর হয়, তখন স্পষ্ট বুঝ। যায়, সমাজের সমস্ত অবশুপ্রয়োজনীয় কার্য অনায়াসে সম্পন্ন হইতেছে। অতএব ওরিজিন্যালিটি সমাজের সচ্ছলতা ও জীবনীশক্তির একট। লক্ষণ । পরস্তু, আমাদের শিক্ষায় আমাদের অত্যাবশ্বকটুকুই ভালো করিয়া চলে না, ওরিজিন্যালিটির অভাবই তাহার প্রধান প্রমাণ। যেখানে বড়োলোক অাছে সেখানে ছোটে। কাজ রীতিমতো চলিতেছে। যতক্ষণ অপর্যাপ্ত না হয় ততক্ষণ সমাজের পক্ষে পর্যাপ্ত হয় না। দেশীভাষায় যদি আমরা শিক্ষালাভ করিতে পারিতাম, তবে সে-শিক্ষা আমাদের পক্ষে অপর্যাপ্ত হইত। আমরা তাহার মধ্যে যথেচ্ছ বিচরণ সঞ্চরণ করিতে পারিতাম, তাহার মধ্যে বাস করিতে পারিতাম এবং ক্রীড়া করিতেও পারিতাম। তাহার মধ্যে কাজও পাইতাম অবকাশও পাইতাম, সেও অামাকে গঠন করিত আমিও তাহাকে গঠন করিতাম। শিক্ষা এবং মনের মধ্যে খুব একটা স্বাভাবিক চলাচল থাকিত। এখন, কথা হইতে পারে বাংলায় এত বই কোথায়। তবে সেই কথাই হউক । বাংলায় যাহাতে পাঠ্য বই হয় সেই চেষ্টা করা যাক । সিণ্ডিকেট-সভ। যদি প্রসন্ন হন, যদি অনুমতি করেন, তবে দরিদ্র বাঙালি এ কাজে এখনই নিযুক্ত হয়। ম্যাক্‌মিলান সাহেবকে অনেককাল অন্ন জোগাইয়াছি, এখন ঘরের অন্ন ঘরের উপবাসী ছেলেদের মুখে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ উঠিলে দেখিয়াও চক্ষু সার্থক হইবে। ওরিজিন্যাল কেতাব না পাওয়া যায় তো তর্জমা করিতে দোষ নাই । জ্ঞান বিজ্ঞান যেখানকারই হউক, ভাষা মাতার হওয়া চাই । শিক্ষাকে এমন আকারে পাওয়া চাই যাহাতে ইচ্ছা করিলে আমরা সকল ভ্রাতাভগিনীই তাহার সমান অধিকারী হইতে পারি। যাহাতে সেই শিক্ষা সুস্থ শরীরের পরিণত রক্তের মতো সহজে সমাজের আপামর সাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত হইতে পারে, কেবল সংকীর্ণ স্থানবিশেষে বদ্ধ হইয়া একটা অত্যন্ত রক্তবর্ণ প্রদাহ উপস্থিত না করে । *. কিন্তু বোধ করি প্রধান আপত্তি এই যে, শিশুকাল হইতে সমস্ত শিক্ষা ইংরেজিভাষায় নির্বাহ না হইলে বাঙালির ছেলে ভালো করিয়া ইংরেজি শিখিতে পারিবে না। চোর মনে করে, যত অধিক পরিমাণে লইব তত শীঘ্ৰ চুরি শেষ হইবে। থলির মুখ সংকীর্ণ, তাহার মধ্যে দুই হাত প্রবেশ করাইয়া দেয় ; বহুলোভে দুই মুঠ ভরিয়া যখন হাত বাহির করিতে চায় তখন হাত বাহির হয় না, অবশেষে মুঠ হইতে চৌর্য সামগ্ৰী র্যখন পড়িয়া যায় তখন হাত বাহির হইয়া আসে । অামাদের শিক্ষা-থলির প্রবেশপথও বড়ো সংকীর্ণ, কারণ, সে-থলি বিদেশী ভাষা । তাহার মধ্যে দুই মুঠ ভরিয়া আমরা লুণ্ঠন করিতে চেষ্টা করি, কিন্তু যখন হাত টানিয়া লই তাহাতে কতটুকু অবশিষ্ট থাকে! বোঝা ভারী করা সহজ, বহন করাই শক্ত। সরল হইতে ক্রমে দুরূহে অধিরোহণ করাই শিক্ষার অভিক্রম। শিক্ষার পদ্ধতিটি আয়ত্ত করাই শিক্ষার একটি প্রধান বাধা, সেই ছাঁচটি একবার গড়িয়া লইতে পারিলে অনেক কঠিন শিক্ষা সহজ হইয়া আসে । ব্যাকরণশিক্ষা ভাষাশিক্ষার একটি প্রণালী ।