পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

es • . ዛ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া জাগাইয় রাখিতে লাগিল ; বিনোদিনী এ-সকল কথা এ-পর্যন্ত এমন করিয়া শোনাইবার লোক পায় নাই— বিশেষত, কোনো পুরুষের কাছে সে এমন আত্মবিশ্বত স্বাভাবিক ভাবে কথা কহে নাই— আজ অজস্র কল কণ্ঠে নিতান্ত সহজ হৃদয়ের কথা বলিয়া তাহার সমস্ত প্রকৃতি যেন নববারিধারায় স্নাত, স্নিগ্ধ এবং পরিতৃপ্ত হইয়া গেল । ভোরে উঠিবার উপদ্রবে ক্লান্ত মহেন্দ্রের পাচটার সময় ঘুম ভাঙিল। বিরক্ত হইয়া কহিল, "এবার ফিরিবার উদযোগ করা যাক ৷” বিনোদিনী কহিল, “আর-একটু সন্ধ্যা করিয়া গেলে কি ক্ষতি আছে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, "না, শেষকালে মাতাল গোরার হাতে পড়িতে হইবে ?” জিনিসপত্র গুছাইয়া তুলিতে অন্ধকার হইয়া আসিল । এমন সময় চাকর আসিয়া খবর দিল, “ঠিক গাড়ি কোথায় গেছে, খুজিয়া পাওয়া যাইতেছে না । গাড়ি বাগানের বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল, দুই জন গোরা গাড়োয়ানের প্রতি বল প্রকাশ করিয়া স্টেশনে লইয়া গেছে।” আর-একটা গাড়ি ভাড়া করিতে চাকরকে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। বিরক্ত মহেন্দ্র কেবলই মনে মনে কহিতে লাগিল, “আজ দিনটা মিথ্যা মাটি হইয়াছে।” অধৈর্য সে আর কিছুতেই গোপন করিতে পারে না, এমনি হইল । শুক্লপক্ষের চাদ ক্রমে শাখাজালজড়িত দিকৃপ্রাস্ত হইতে মুক্ত আকাশে আরোহণ করিল। নিস্তব্ধ নিষ্কম্প বাগান ছায়ালোকে খচিত হইয়া উঠিল। আজ এই মায়ামণ্ডিত পৃথিবীর মধ্যে বিনোদিনী আপনাকে কী-একটা অপূর্বভাবে অনুভব করিল। আজ সে যখন তরুবীথিকার মধ্যে আশাকে জড়াইয়া ধরিল, তাহার মধ্যে প্রণয়ের কৃত্রিমতা কিছুই ছিল না। আশা দেখিল, বিনোদিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। আশা ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী ভাই চোখের বালি, তুমি কাদিতেছ কেন ?” বিনোদিনী কহিল, “কিছুই নয় ভাই, আমি বেশ আছি। আজ দিনটা আমার বড়ো ভালো লাগিল ।” আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে তোমার এত ভালো লাগিল, ভাই ।” বিনোদিনী কহিল, “আমার মনে হইতেছে, আমি যেন মরিয়া গেছি, যেন পরলোকে আসিয়াছি, এখানে যেন আমার সমস্তই মিলিতে পারে।” বিস্মিত আশা এ-সব কথা কিছুই বুঝিতে পারিল না । সে মৃত্যুর কথা শুনিয়া দুঃখিত হইয়া কহিল, "ছি ভাই চোখের বালি, অমন কথা বলিতে নাই।”