পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব ৩৩৯ এ বিষয়ে আলোচনা করিবার পূর্বে একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্বক। বাংলা দেশের নানাস্থানে নানাপ্রকার উচ্চারণের ভঙ্গী আছে। কলিকাতা-অঞ্চলের উচ্চারণকেই আদর্শ ধরিয়া লইতে হইবে। কারণ, কলিকাতা রাজধানী। কলিকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংক্ষিপ্তসার । * হরি শব্দে আমরা হ যেরূপ উচ্চারণ করি, হর শব্দে হ সেরূপ উচ্চারণ করি না। দেখা শব্দের একার একরূপ এবং দেখি শব্দের একার আর-একরূপ । পবন শব্দে প অকারাস্ত, ব ওকারাস্ত, ন হসন্ত শব্দ। শ্বাস শব্দের শ্ব-র উচ্চারণ বিশুদ্ধ শ-এর মতো, কিন্তু বিশ্বাস শব্দের শ্ব-এর উচ্চারণ শ শ-এর ন্যায়। ‘ব্যয়’ লিখি কিন্তু পড়ি—ব্যায়। অথচ অব্যয় শব্দে ব্য-এর উচ্চারণ বব-এর মতো। আমরা লিখি গর্দভ, পড়ি— গধোব। লিখি সিহ’, পড়ি— সোঝে । এমন কত লিখিব । আমরা বলি আমাদের তিনটে স-এর উচ্চারণের কোনো তফাত নাই, বাংলায় সকল স-ই তালব্য শ-এর ন্যায় উচ্চারিত হয় ; কিন্তু আমাদের যুক্ত-অক্ষর উচ্চারণে এ কথা খাটে না। তার সাক্ষ্য দেখো কষ্ট শব্দ এবং ব্যস্ত শব্দের দুই শ-এর উচ্চারণের প্রভেদ আছে। প্রথমটি তালব্য শ, দ্বিতীয়টি দস্ত্য স । ‘আসতে হবে? এবং “আশ্চর্য এই উভয় পদে দন্ত্য স ও তালব্য শ-এর প্রভেদ রাখা হইয়াছে । জ-এর উচ্চারণ কোথাও বা ইংরেজি z-এর মতে হয়, যেমন লুচি ভাজতে হবে, এ স্থলে ভাজতে শব্দের জ ইংরেজি z-র মতো। " সচরাচর আমাদের ভাষায় অস্ত্যস্থ ব-এর আবশ্যক হয় না বটে, কিন্তু জিহব| অথবা আহবান শব্দে অস্ত্যস্থ ব ব্যবহৃত হয় । আমরা লিখি তাহারা’ কিন্তু উচ্চারণ করি – তাহারা অথবা তাহারা। এমন আরো অনেক দৃষ্টাস্ত আছে। বাংলাভাষায় এইরূপ উচ্চারণের বিশৃঙ্খলা যখন নজরে পড়িল, তখন আমার জানিতে কৌতুহল হইল, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা নিয়ম আছে কি না। আমার কাছে তখন খানদুই বাংলা অভিধান ছিল । মনোযোগ দিয়া তাহা হইতে উদাহরণ সংগ্ৰহ করিতে লাগিলাম। যখন আমার খাতায় অনেকগুলি উদাহরণ সঞ্চিত হইল, তখন তাহা হইতে একটা নিয়ম বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এই-সকল উদাহরণ এবং তাহার টীকায় রাশি রাশি কাগজ পুরিয়া গিয়াছিল। যখন দেশে আসিলাম তখন এই কাগজগুলি আমার সঙ্গে ছিল । একটি চামড়ার বাক্সে সেগুলি রাখিয়া আমি অত্যন্ত নিশ্চিস্ত ছিলাম। দুই বৎসর হইল, একদিন সকালবেলায় ধুলা ঝাড়িয়া বাক্সটি খুলিলাম, ভিতরে চাহিয়া দেখি— গোটাদশেক হলদে রং-করা মস্ত