পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ৩৭৯ খাবার সময় হাজির হইতে পারি নাই, মাপ করিয়ো, ঠাকুরপো । আর যাই কর, আমার মাথার দিব্য রহিল, তোমার অযত্ব হইতেছে, এ-খবরটা আমার চোখের বালিকে দিয়ে না। আমার যথাসাধ্য আমি করিতেছি— কিন্তু কী করিব ভাই, সংসারের সমস্ত কাজই আমার ঘাড়ে ।” এই বলিয়া বিনোদিনী পানের বাট মহেন্দ্রের সম্মুখে অগ্রসর করিয়া দিল । আজিকার পানের মধ্যেও কেয়া-খয়েরের একটু বিশেষ নুতন গন্ধ পাওয়া গেল । মহেন্দ্র কহিল, "যত্বের মাঝে-মাঝে এমন এক-একটা ক্ৰটি থাকাই ভালো ।” বিনোদিনী কহিল, “ভালো কেন, শুনি ।” মহেন্দ্র উত্তর করিল, “তার পরে খোটা দিয়া স্বদসুদ্ধ আদায় করা যায় ।” “মহাজন-মহাশয়, সুদ কত জমিল ।” মহেন্দ্র কহিল, “থাবার সময় হাজির ছিলে না, এখন খাবার পরে হাজরি পোষাইয়া আরো পাওনা বাকি থাকিবে ।” বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “তোমার হিসাব যে-রকম কড়াক্কড়, তোমার হাতে একবার পড়িলে আর উদ্ধার নাই দেখিতেছি ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “হিসাবে যাই থাক, আদায় কী করিতে পারিলাম।” বিনোদিনী কহিল, “আদায় করিবার মতো আছে কী । তবু তো বন্দী করিয়া রাখিয়াছ ।" বলিয়া ঠাটাকে হঠাৎ গাম্ভীর্ষে পরিণত করিয়া ঈষৎ একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । মহেন্দ্রও একটু গম্ভীর হইয়া কহিল, “ভাই বালি, এটা কি তবে জেলখানা ।” এমন সময় বেহারা নিয়মমতো আলো অনিয়া টিপাইয়ের উপর রাখিয়া চলিয়া গেল । হঠাৎ চোখে আলো লাগাতে মুখের সামনে একটু হাতের আড়াল করিয়া নতনেত্রে বিনোদিনী বলিল, “কী জানি ভাই । তোমার সঙ্গে কথায় কে পরিবে । এখন যাই, কাজ আছে ।” মহেন্দ্র হঠাৎ তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “বন্ধন যখন স্বীকার করিয়াছ তখন যাইবে কোথায় ?” । বিনোদিনী কহিল, “ছি ছি, ছাড়ো । যাহার পালাইবার রাস্তা নাই, তাহাকে আবার বাধিবার চেষ্টা কেন ।” বিনোদিনী জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া প্রস্থান করিল। মহেন্দ্র সেই বিছানায় স্বগন্ধ বালিশের উপর পড়িয়া রহিল, তাহার বুকের মধ্যে