পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७३१ রবীন্দ্র-রচনাবলী ষে নিৰ্জীৰ, যে সহজ পথ খুজিয়া আপনাকে ভুলাইয়া রাখিতেই চায়, তাহাকে জুলাইবার জন্ত আশাকে অধিক বেশি ছলনা বিস্তার করিতে হয় না। সে হয়তো এখনো মনে করিতেছে, যদি এখানকার রাজার হইতে ভিক্ষুককে তাড়া খাইতে হয়, তৰে ভিক্ষার ঝুলি ঘাড়ে করিয়া সমুদ্রপারে যাইতে হইবে । সমুদ্রের এ-পারেই কি আর ও-পারেই কি, অনন্যশরণ কাঙাল সেই একই চরণ আশ্রয় করিয়াছে । কিন্তু এ-দশা আমাদের পুরুষদের মধ্যে সকলের নহে— তাহাজের বহুদিনের বিশ্বাসক্ষেত্রে ভূমিকম্প উপস্থিত হইয়াছে, তাহদের ভক্তি টলিয়াছে, তাহাদের আশা খিলালে-খিলানে ফাটিয়া ফাক হইয়া গেছে— এখন তাহারা ভাৰিতেছেন, ইহার চেয়ে নিজের দীনহীন কুটির আশ্রয় করাও নিরাপদ। এখন তাই সমস্ত দেশের মধ্যে নিজের শক্তিকে অবলম্বন করিবার জন্য একটা মৰ্মভেদী আহবান উঠিয়াছে । এই আহবানে যে পুরুষেরা কী ভাবে সাড়া দিবেন তাহা জানি না— কিন্তু আমাদের অস্তঃপুরেও কি এই আহবান প্রবেশ করে নাই । আমরা কি আমাদের মাতৃভূমির কস্তা নহি । দেশের অপমান কি আমাদের অপমান নহে। দেশের দুঃখ কি আমাদের গৃহপ্রাচীরের পাষাণ ভেদ করিতে পারিবে না । ভগিনীগণ, আপনারা হয়তো কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করিবেন, আমরা স্ত্রীলোক, আমরা কী করিতে পারি— দুঃখের দিনে নীরবে অশ্রুবর্ষণ করাই আমাদের সম্বল । এ-কথা আমি স্বীকার করিতে পারিব না। আমরা যে কী না করিতেছি, তাই দেখুন। আমরা পরনের শাড়ি কিনিতেছি বিলাত হইতে, আমাদের অনেকের ভূষণ জোগাইতেছে হামিণ্টন, আমাদের গৃহসজ্জা বিলাতি দোকানের, আমরা শয়নে স্বপনে বিলাতের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া আছি । আমরা এতদিন আমাদের জননীর অন্ন কাড়িয়া তাহার ভূষণ ছিনাইয়া বিলাত-দেবতার পায়ে রাশি রাশি অর্ঘ্য জোগাইতেছি । আমরা লড়াই করিতে যাইব না, আমরা ভিক্ষা করিতেও ফিরিব না, কিন্তু আমরা কি এ-কথা বলিতে পারিব না যে, “না, আর নয়— আমাদের এই অপমানিত উপবাসক্লিষ্ট মাতৃভূমির অল্পের গ্রাস বিদেশের পাতে তুলিয়া দিয়া তাহার পরিবর্তে আমাদের বেশভূষার শখ মিটাইব না ? আমরা ভালো হউক, মন্দ হউক, দেশের কাপড় পরিব, দেশের জিনিস ব্যবহার করিব।” ভগিনীগণ, সৌন্দর্যচর্চার দোহাই দিবেন না ! সৌন্দর্যবোধ অতি উত্তম পদার্থ, কিন্তু তাহার চেয়েও উচ্চ জিনিস আছে । আমি এ-কথা স্বীকার করিব না, যে, দেশী জিনিসে আমাদের সৌন্দর্যবোধ ক্লিষ্ট হইবে ; কিন্তু যদি শিক্ষা ও অভ্যাসক্রমে আমাদের সেই রূপই ধারণা হয়, তবে এই কথা বলিব, সৌন্দর্যবোধকেই সকলের চেয়ে বড়ো