পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শবদতত্ত্ব 8 o X আমরা এতক্ষণ যে-সকল জোড়াকথার দৃষ্টান্ত লইয়। আলোচনা করিলাম তাহার বিশুদ্ধ ধ্বন্তাত্মক। আর-একরকমের জোড়াকথা আছে তাহার মূলশব্দটি অর্থস্থচক এবং দোসর শব্দটি মূলশব্দেরই অর্থহীন বিকার ; যেমন, চুপচাপ ঘুষঘাষ তুকতাক ইত্যাদি। চুপ ঘুষ এবং তুক এ-তিনটে শব্দ আভিধানিক, ইহারা অর্থহীন ধ্বনি নহে ; ইহাদের সঙ্গে চাপ ঘাষ ও তাক, এই তিনটে অর্থহীন শব্দ শুদ্ধমাত্র ইঙ্গিতের কাজ করিতেছে। জলের ধারেই যে-গাছটা দাড়াইয়া আছে সেই গাছটার সঙ্গে সঙ্গে তাহার সংলগ্ন বিকৃত ছায়াটাকে একত্র করিয়া দেখিলে যেমন হয়, বাংলাভাষার এই কথাগুলাও সেইরূপ : চুপ কথাটার সঙ্গে তাহার একটা বিকৃত ছায়া যোগ করিয়া দিয়া চুপচাপ হইয়া গেল। ইহাতে অর্থেরও একটু অনির্দিষ্টভাবের বিস্তৃতি হইল। যদি বলা যায় কেহ চুপ করিয়া আছে, তবে বুঝায় সে নি:শব্দ হইয়া আছে ; কিন্তু যদি বলি চুপচাপ আছে, তবে বুঝায় লোকটা কেবলমাত্র নি:শব্দ নহে একপ্রকার নিশ্চেষ্ট হইয়াও আছে । একটা নির্দিষ্ট অর্থের পশ্চাতে একটা অনির্দিষ্ট আভাস জুড়িয়া দেওয়া এই শ্রেণীর জোড়াকথার কাজ । ছায়াটা আসল জিনিসের চেয়ে বড়োই হইয়া থাকে। অনির্দিষ্টট নির্দিষ্টের চেয়ে অনেক মস্ত । আকার স্বরটাই বাংলায় বড়োত্বের মুর লাগাইবার জন্য আছে। আকার স্বরবর্ণের যোগে ঘুষঘাষ-এর ঘাষ, তুকতাক-এর তাক, ঘুষ অর্থ ও তুক অর্থকে কল্পনাক্ষেত্রে অনেকখানি বাড়াইয়া দিল অথচ স্পষ্ট কিছুই বলিল না। কিন্তু যেখানে মূলশব্দে আকার আছে সেখানে দোসর শব্দে এ নিয়ম খাটে না, পুনর্বার আকার যোগ করিলে কথাট। দ্বিগুণিত হইয় পড়ে। কিন্তু দ্বিগুণিত করিলে তাহার অর্থ অন্য রকম হইয়া যায়। যদি বলি গোল-গোল, তাহাতে হয় একাধিক গোল পদার্থকে বুঝায় নয় প্রায়-গোল জিনিসকে বুঝায়। কিন্তু গোল-গাল বলিলে গোল আকৃতি বুঝায়, সেই সঙ্গেই পরিপুষ্টতা প্রভৃতি আরও কিছু অনির্দিষ্ট ভাব মনে আনিয়া দেয় । এইজন্য এইপ্রকার অনির্দিষ্ট ব্যঞ্জনার স্থলে দ্বিগুণিত করা চলে না, বিকৃতির প্রয়োজন । তাই গোড়ায় যেখানে আকার অাছে সেখানে দোসর শব্দে অন্য স্বরবর্ণের প্রয়োজন ; তাহার দৃষ্টাস্ত, দাগদোগ ডাকডোক বাছবোছ সাজসোজ ছাটছোট চালচোল ধারধোর সাফসোফ । অন্যরকম : কাটাকোটা খাটাখোটা ডাকাডোকা ঢাকঢোকা ঘাঁটাঘেটি ছাট ছোট ঝাড়াঝোড়া চাপাচোপা ঠাসাঠোস কালোকোলে ।