পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७8९ রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া যায়। বিনোদিনী মনে বুঝিতে পারিত, বিহারী তাহার শুশ্রুষাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেছে । সেইজন্য বিহারীর আগমনে সে যেন বিশেষ পুরস্কার লাভ করিত । মহেন্দ্র নিতান্ত ধিক্কারবেগে অত্যন্ত কড়া নিয়মে কালেজে বাহির হইতে লাগিল । একে তাহার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ হইয়া রহিল, তাহার পরে এ কী পরিবর্তন। খাবার ঠিক সময়ে হয় না, সইসটা নিরুদ্দেশ হয়, মোজাজোড়ার ছিদ্র ক্রমেই অগ্রসর হইতে থাকে। এখন এই সমস্ত বিশৃঙ্খলায় মহেন্দ্রের পূর্বের ন্যায় আমোদ বোধ হয় না। যখন যেটি দরকার, তখনি সেটি হাতের কাছে স্থসজ্জিত পাইবার আরাম কাহাকে বলে, তাহা সে কয়দিন জানিতে পারিয়াছে। এক্ষণে তাহার অভাবে, আশার অশিক্ষিত অপটুতায় মহেঞ্জের আর কৌতুকবোধ হয় না – "চুনি, আমি তোমাকে কতদিন বলিয়াছি, স্বানের আগেই আমার জামায় বোতাম পরাইয়া প্রস্তুত রাখিবে, আর আমার চাপকান-প্যাণ্টলুন ঠিক করিয়া রাখিয়া দিবে— একদিনও তাহা হয় না । স্বানের পর বোতাম পরাইতে আর কাপড় খুজিয়া বেড়াইতে আমার দু-ঘণ্টা যায়।” অমৃতপ্ত আশা লজ্জায় মান হইয়া বলে, “আমি বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলাম।” "বেহারাকে বলিয়া দিয়াছিলে ! নিজের হাতে করিতে দোষ কী । তোমার দ্বারা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায় ।” ইহা আশার পক্ষে বজ্ৰাঘাত । এমন ভৎসনা সে কখনো পায় নাই ! এ জবাব তাহার মুখে বা মনে আসিল না যে, “তুমিই তো আমার কর্মশিক্ষার ব্যাঘাত করিয়াছ।” এই ধারণাই তাহার ছিল না যে, গৃহকর্মশিক্ষা নিয়ত অভ্যাস-ও অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ। সে মনে করিত, “আমার স্বাভাবিক অক্ষমতা- ও নির্ব দ্বিতা-বশতই কোনো কাজ ঠিকমতো করিয়া উঠিতে পারি না ।” মহেন্দ্র যখন আত্মবিস্মৃত হইয়া বিনোদিনীর সহিত তুলনা দিয়া আশাকে ধিক্কার দিয়াছে, তখন সে তাহ বিনয়ে ও বিনা বিদ্বেষে গ্রহণ করিয়াছে । আশা এক-একবার তাহার রুগ্ন শাশুড়ীর ঘরের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়— এক-একবার লজ্জিতভাবে ঘরের স্বারের কাছে আসিয়া দাড়ায় । সে নিজেকে সংসারের পক্ষে আবশ্বক করিয়া তুলিতে ইচ্ছা করে, সে কাজ দেখাইতে চায়, কিন্তু কেহ তাহার কাজ চাহে না । সে জানে না কেমন করিয়া কাজের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, কেমন করিয়া সংসারের মধ্যে স্থান করিয়া লইতে হয় । সে নিজের অক্ষমতার সংকোচে বাহিরে বাহিরে ফিরে। তাহার কী-একটা মনোবেদনার কথা অন্তরে প্রতিদিন বাড়িতেছে, কিন্তু তাহার সেই অপরিস্ফুট বেদন, সেই অব্যক্ত আশঙ্কাকে সে স্পষ্ট