পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

84२ রবীন্দ্র-রচনাবলী '. চিহ্ন দেখি নে। পারস্যদেশের বেশির ভাগ উচ্চ মালভূমি, পাহাড়ে বেষ্টিত, আবার মাঝে মাঝে গিরিশ্ৰেণী। এই মালভূমি সমুদ্র-উপরিতল থেকে পাঁচ-ছয় হাজার ফিট উচু। এর মাঝখানটা নেমে গিয়েছে প্রকাও এক মরুভূমিতে। এই অধিত্যকায় পাহাড় ডিঙিয়ে মেঘ পৌছতে বাধা পায়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অতি অল্প। পর্বত থেকে জলস্রোত নেমে মাঝে মাঝে উর্বরতা স্বষ্টি করে। কিন্তু ক্ষীণজল এই স্রোতগুলি সমুদ্র পর্যন্ত প্রায় পৌছয় না, মরু নেয় তাদের শুষে কিম্বা জলার মধ্যে তাদের দুৰ্গতি ঘটে । বন্ধুর পথে নাড়া খেতে খেতে ক্রমে সেই বিশাল নীরস শূন্যতার মধ্যে দূরে দেখা যায় খেজুরের কুঞ্জ, কোথাও-বা বাবলা। এই জনবিরল জায়গায় দশ মাইল অন্তর সশস্ত্র পুলিস পাহারা। পথে পথিক প্রায় দেখি নে। আমাদের দেশ হলে আর্তনাদমুখর গোরুর গাড়ি দেখা যেত। এ দেশে তার জায়গায় পিঠের দুই পাশে বোঝা ঝুলিয়ে গাধা কিম্বা দল-বাধা খচ্চর, মাঝে মাঝে ভেড়ার পাল নিয়ে মেষপালক, দুই-এক জায়গায় কাটাঝোপের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে উটের দল। বেলা যায়, রৌদ্র বেড়ে ওঠে। মোটর-চক্রোংক্ষিপ্ত ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইছে, আমাদের শীতের হাওয়ার মতো ঠাণ্ডা। কচিৎ এক-এক জায়গায় দেখি তোরণওয়ালা মাটির ছোটো কেল্লা, সেখানে মোটর দাড় করিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। ডান দিগন্তে একটা পাহাড়ের চেহারা ফুটে উঠেছে, যাত্রা-আরম্ভে আকাশের ঘোলা নীলের মধ্যে এ পাহাড় অবগুষ্ঠিত ছিল। এই অঞ্চলটায় বাষ ক্রি জাতের বাস, তাদের ভাষা তুকি। পূর্বতন রাজার আমলে এখানে তাদের বসতি পত্তন হয়। এদের ব্যাবসা ছিল দস্থ্যবৃত্তি। নূতন আমলে এদের ঠাণ্ড করা হচ্ছে। শোনা গেল কিছুদিন আগে পথের মধ্যে এরা একটা সঁাকে৷ ভেঙে রেখেছিল। মালবোঝাই মোটরবাস উলটে পড়তেই খুনজখম লুটপাট করে। এই ঘটনার পরে রাজা তাদের প্রধানের ছেলেকে জামিনস্বরূপে তেহেরানে নিয়ে রেখেছেন । শাস্তিটা কঠোর নয়, অথচ কেজো । এই জাতের দলপতি শাকৃরুল্লা খ৷ র্তার বসতিগ্রাম থেকে এসে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে গেলেন । আর কয়েক বছর আগে হলে এই অভিবাদনের ভাষা সম্পূর্ণ অন্যরকম হত, যাকে বলা যেতে পারত মৰ্মগ্রাহী। বুশেয়ার থেকে বরাবর আমাদের গাড়ির আগে আগে আর-একটি মোটরে বন্ধুকধারী পাহারা চলেছে। প্রথমে মনে করেছিলুম বুঝি-বা এটা রাজকায়দার বাহুল্য অলংকার, এখন বোধ হচ্ছে এর একটি জরুরি অর্থ থাকতেও পারে। মেটে রাস্ত ক্রমে মুড়ি-বিছানো হয়ে এল। বোঝা যায় পাহাড়ের বুকে উঠছি।