পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২১ e রবীন্দ্র-রচনাবলী কালেজে যাইত সেই সময়ে সে লুকাইয়৷ বহু যত্নে কাপেটের সেলাই শিখিতে লাগিল। এবং অমল নিজে যখন তাহার জুতার দরবার সম্পূর্ণ ভুলিয়া বসিয়াছে এমন সময় একদিন সন্ধ্যাবেলায় চারু তাহাকে নিমন্ত্ৰণ করিল। গ্রীষ্মের সময় ছাদের উপর আসন করিয়া অমলের আহারের জায়গা করা হইয়াছে। বালি উড়িয়া পড়িবার ভয়ে পিতলের ঢাকনায় থালা ঢাকা রহিয়াছে । অমল কলেজের বেশ পরিত্যাগ করিয়া মুখ ধুইয়৷ ফিট্‌ফাটু হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। অমল আসনে বসিয়া ঢাকা খুলিল ; দেখিল, থালায় একজোড়া নূতন-বাধানে পশমের জুতা সাজানো রহিয়াছে। চারুলত উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। জুতা পাইয়া আমলের আশা আরো বাড়িয়া উঠিল। এখন গলাবন্ধ চাই, রেশমের রুমালে ফুলকাটা পাড় সেলাই করিয়া দিতে হইবে, তাহার বাহিরের ঘরে বসিবার বড়ো কেদারায় তেলের দাগ নিবারণের জন্য একটা কাজ-করা আবরণ আবশ্বক। প্রত্যেক বারেই চারুলতা আপত্তি প্রকাশ করিয়া কলহ করে এবং প্রত্যেক বারেই বহু যত্নে ও স্নেহে শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়। অমল মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে, “বউঠান, কতদূর হইল।” চারুলতা মিথ্যা করিয়া বলে, “কিছুই হয় নি।” কখনো বলে, “সে আমার মনেই ছিল না।” কিন্তু অমল ছাড়িবার পাত্র নয়। প্রতিদিন স্মরণ করাইয়া দেয় এবং আবদার করে। নাছোড়বান্দা আমলের সেই-সকল উপদ্রব উদ্রেক করাইয়া দিবার জন্যই চারু ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া বিরোধের স্বষ্টি করে এবং হঠাৎ একদিন তাহার প্রার্থনা পূরণ করিয়া দিয়া কৌতুক দেখে । ধনীর সংসারে চারুকে আর কাহারে জন্য কিছুই করিতে হয় না, কেবল অমল তাহাকে কাজ না করাইয়া ছাড়ে না। এই-সকল ছোটোখাটো শখের খাটুনিতেই তাহার হৃদয়বৃত্তির চর্চা এবং চরিতার্থত হইত। f ভূপতির অন্তঃপুরে যে একখণ্ড জমি পড়িয়া ছিল তাহাকে বাগান বলিলে অনেকটা অত্যুক্তি করা হয়। সেই বাগানের প্রধান বনস্পতি ছিল একটা বিলাতি আমড়া গাছ। এই ভূখণ্ডের উন্নতিসাধনের জন্য চারু এবং অমলের মধ্যে একটা কমিটি বসিয়াছে। উভয়ে মিলিয়া কিছুদিন হইতে ছবি আঁকিয়া, প্ল্যান করিয়া, মহা উৎসাহে এই জমিটার উপরে একটা বাগানের কল্পনা ফলাও করিয়া তুলিয়াছে। অমল বলিল, “বউঠান, আমাদের এই বাগানে সেকালের রাজকন্যার মতে তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে ।”