পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৭১ উপসংহার লেখা পাঠানো হইয়াছে। বৈশাখের সংখ্যায় পুরস্কারযোগ্য গল্পটি বাহির হইবে। যদিও আমার মনে কোনো আশঙ্কা ছিল না, তবু সময় যত নিকটবতী হইল, মনটা তত চঞ্চল হইয়া উঠিল। বৈশাখ মাসও আসিল । একদিন আদালত হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়া আসিয়া খবর পাইলাম, বৈশাখের ‘উদ্দীপনা আসিয়াছে, আমার স্ত্র। তাহ পাইয়াছে। ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদে অস্তঃপুরে গেলাম। শয়নঘরে উকি মারিয়া দেখিলাম, আমার স্ত্রী কড়ায় আগুন করিয়া একটা বই পুড়াইতেছে। দেয়ালের আয়নায় নিঝরিণীর মুখের যে প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে তাহাতে স্পষ্ট বুঝা গেল, কিছু পূর্বে সে অশ্রুবর্ষণ করিয়া লইয়াছে। মনে আনন্দ হইল, কিন্তু সেইসঙ্গে একটু দয়াও হইল। আহা, বেচারার গল্পটি ‘উদ্দীপনায় বাহির হয় নাই। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারে এত দুঃখ! স্ত্রীলোকের অহংকারে এত অল্পেই ঘা পড়ে। আবার আমি নিঃশব্দপদে ফিরিয়া গেলাম। উদ্দীপনা-আপিস হইতে নগদ দাম দিয়া একটা কাগজ কিনিয়া আনাইলাম। আমার লেখা বাহির হইয়াছে কি না দেখিবার জন্ত কাগজ খুলিলাম। স্থচীপত্র দেখিলাম, পুরস্কারযোগ্য গল্পটির নাম “বিক্রমনারায়ণ নহে, তাহার নাম “ননদিনী’, এবং তাহার রচয়িতার নাম— এ কী ! এ যে নিঝরিণী দেবী ! বাংলাদেশে আমার স্ত্রী ছাড়া আর কাহারে নাম নিঝরিণী আছে কি। গল্পটি খুলিয়া পড়িলাম। দেখিলাম, নিঝরের সেই হতভাগিনী জাঠতুতো বোনের বৃত্তাস্তটিই ডালপালা দিয়া বর্ণিত। একেবারে ঘরের কথা– সাদা ভাষা, কিন্তু সমস্ত ছবির মতো চোখে পড়ে এবং চক্ষু জলে ভরিয়া যায়। এ নিঝরিণী যে আমারই নিঝর তাহাতে সন্দেহ নাই । তখন আমার শয়নম্বরের সেই দাহদৃশ্ব এবং ব্যথিত রমণীর সেই মানমুখ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম । রাত্রে শুইতে আসিয়া স্ত্রীকে বলিলাম, নিঝর, যে খাতায় তোমার লেখাগুলি আছে সেটা কোথায় ।” নিঝরিণী কহিল, "কেন, সে লইয়া তুমি কী করিবে।” আমি কহিলাম, “আমি ছাপিতে দিব।”