পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Sbr\ව নাই, প্রতিবেশীরা দয়া করিয়া আমাকে সাহায্য করিতে আসিল । সর্বস্বাস্ত কৃতজ্ঞ হরিনাথ দিনরাত্রি খাটিতে লাগিল । গায়ে-হলুদের দিনে রাত তিনটার সময় হঠাৎ শশীকে ওলাউঠায় ধরিল। রোগ উত্তরোত্তর কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। অনেক চেষ্টার পর নিস্ফল ঔষধের শিশিগুল৷ ভূতলে ফেলিয়া ছুটিয়া গিয়া হরিনাথের পা জড়াইয়া ধরিলাম। কহিলাম, “মাপ করে দাদা, এই পাষণ্ডকে মাপ করে । আমার একমাত্র কন্যা, আমার আর কেহ নাই ।” হরিনাথ শশব্যস্ত হইয়া কহিল, “ডাক্তারবাবু, করেন কী, করেন কী। আপনার কাছে আমি চিরঋণী, আমার পায়ে হাত দিবেন না।” আমি কহিলাম, “নিরপরাধে আমি তোমার সর্বনাশ করিয়াছি, সেই পাপে আমার কন্যা মরিতেছে।” এই বলিয়া সর্বলোকের সমক্ষে আমি চীংকার করিয়া বলিলাম, “ওগো, আমি এই বৃদ্ধের সর্বনাশ করিয়াছি, আমি তাহার দণ্ড লইতেছি, ভগবান আমার শশীকে রক্ষা করুন ।” বলিয়া হরিনাথের চটিজুতা খুলিয়া লইয়া নিজের মাথায় মারিতে লাগিলাম, বৃদ্ধ ব্যস্তসমস্ত হইয়া আমার হাত হইতে জুতা কাড়িয়া লইল । পরদিন দশটা-বেলায় গায়ে-হলুদের হরিদ্রাচিহ্ন লইয়া শশী ইহসংসার হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিল। তাহার পরদিনেই দারোগাবাবু কহিলেন, “ওহে আর কেন, এইবার বিবাহ করিয়া ফেলে। দেখাশুনার তো একজন লোক চাই ?” মানুষের মর্মাস্তিক দুঃখশোকের প্রতি এরূপ নিষ্ঠুর অশ্রদ্ধা শয়তানকেও শোভা পায় না। কিন্তু, নানা ঘটনায় দারোগার কাছে এমন মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়াছিলাম যে, কোনো কথা বলিবার মুখ ছিল না। দারোগার বন্ধুত্ব সেই দিন যেন আমাকে চাবুক মারিয়া অপমান করিল। হৃদয় যতই ব্যথিত থাকৃ, কর্মচক্ৰ চলিতেই থাকে। আগেকার মতোই ক্ষুধার আহার, পরিধানের বস্ত্র, এমন-কি, চুলার কাঠ এবং জুতার ফিতা পর্যন্ত পরিপূর্ণ উদ্যমে নিয়মিত সংগ্ৰহ করিয়া ফিরিতে হয় । কাজের অবকাশে যখন একলা ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকি তখন মাঝে মাঝে কানে সেই করুণ কষ্ঠের প্রশ্ন বাজিতে থাকে, “বাবা, ঐ বুড়ো তোমার পায়ে ধরিয়া কেন অমন করিয়া কাদিতেছিল।” দরিদ্র হরিনাথের জীর্ণ ঘর নিজের ব্যয়ে ছাইয়া দিলাম,