পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্তে 8st প্রতিনিধি এসে আমাকে সম্মান জানিয়ে গেলেন, ভারতীয়ের দিলেন মালা পরিয়ে । ছোটো ছোটো দুটি মেয়ে দিয়ে গেল ফুলের তোড়া । মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে একটি বাঙালি মেয়েকেও দেখলেম । বোগদাদের রাস্ত কতকটা আমাদেরই দেশের দোকানবাজার-ওয়াল পথের মতো। একটা বিশেষত্ব আছে, মাঝে মাঝে পথের ধারে কাঠের বেঞ্চি -পাতা চা খাবার এবং মেলামেশা করবার জায়গা। ছোটোখাটো ক্লাবের মতো । সেখানে আসর জমেছে। এক-এক শ্রেণীর লোক এক-একটি জায়গা অধিকার করে থাকে, সেখানে আলাপের প্রসঙ্গে ব্যাবসার জেরও চলে। শহরের মতো জায়গায় এরকম সামাজিকতাচৰ্চার কেন্দ্র থাকা বিশেষ আবশ্বক সন্দেহ নেই। আগেকার দিনে গল্প বলবার কথক ছিল, তখন তারা এই-সকল পথপ্রাস্তসভায় কথা শোনাত। অামাদের দেশে যেমন কথকের ব্যাবসা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে, এদের এখানেও তাই। এই বিদ্যাটি ছাপার বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারলে না । মানুষ আপন রচিত যন্ত্রগুলোর কাছে আপন সহজ শক্তিকে বিকিয়ে দিচ্ছে । টাইগ্রিস নদীর ধারে একটি হোটেলে আমাদের জায়গা হয়েছে। আমার ঘরের সামনে মস্ত ছাদ, সেখানে বসে নদী দেখা যায়। টাইগ্রিস প্রায় গঙ্গার মতোই প্রশস্ত, ওপারে ঘন গাছের সার, খেজুরের বন, মাঝে মাঝে ইমারত। আমাদের ডান দিকে নদীর উপর দিয়ে ব্রিজ চলে গেছে। এই কাঠের ব্রিজ সৈন্ত-পারাপারের জন্ত গত যুদ্ধের সময় জেনারেল মভ অস্থায়ীভাবে তৈরি করিয়েছিলেন। চেষ্টা করছি বিগ্রাম করতে, কিন্তু সম্ভাবনা অল্প। নানারকম অনুষ্ঠানের ফর্দ লম্বা হয়ে উঠছে। সকালে গিয়েছিলুম মুজিয়ম দেখতে ; নূতন স্থাপিত হয়েছে, বেশি বড়ে নয়, একজন জর্মান অধ্যাপক এর অধ্যক্ষ । অতি প্রাচীন যুগের যে-সব সামগ্ৰী মাটির নীচে থেকে বেরিয়েছে সেগুলি দেখালেন । এ-সমস্ত পাচ-ছয় হাজার বছর আগেকার পরিশিষ্ট । মেয়েদের গহনা, ব্যবহারের পাত্র প্রভৃতি সুদক্ষ হাতে রচিত ও অলংকৃত। অধ্যাপক বলেন, এই জাতের কারুকার্যে স্থূলতা নেই, সমস্ত সুকুমার ও সুনিপুণ। পূর্ববর্তী দীর্ঘকালের অভ্যাস না হলে এমন শিল্পের উদ্ভব হওয়া সম্ভবপর হত না । এদের কাহিনী নেই জানা, কেবল চিহ্ন আছে। এটুকু বোঝা যায় এর বর্বর ছিল না। পৃথিবীর দিনরাত্রির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের স্মরণভষ্ট এই-সব নরনারীর সুখদুঃখের পর্যায় আমাদেরই মতো বয়ে চলত। ধর্মে কর্মে লোকব্যবহারে এদেরও জীবনযাত্রার আর্থিক-পারমার্থিক সমস্যা ছিল বহুবিচিত্র । অবশেষে, কী আকারে ঠিক জানি নে, কোন চরম সমস্ত বিরাটমূতি নিয়ে এদের সামনে এসে দাড়াল, এদের জ্ঞানী কর্মী ভাবুক, এদের পুরোহিত, এদের সৈনিক, এদের রাজা, তার কোনো সমাধান করতে