পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৭৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী বিবাহের মন্ত্ৰ পড়িয়াছে সকল গুণ তাহার এবং সকল আদর তাহারই জন্য । স্বামীর আধঘণ্টা খাবার সময় অতীত হইয় গেলে অসহ্য হয়, আর, স্বামীর আশ্রিতকে দূর করিয়া দিলে তাহার একমুষ্টি অন্ন জুটবে না, এ সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। স্ত্রীলোকের এই বিবেচনাহীন পক্ষপাত দূষণীয় হইতে পারে, কিন্তু চিত্তরঞ্জনের নিকট তাহা নিতান্ত অপ্রীতিকর বোধ হইল না। এইজন্য তিনি যখন-তখন বেশিমাত্রায় বিপিনের গুণগান করিয়া স্ত্রীকে খ্যাপাইতেন ও বিশেষ আমোদ বোধ করিতেন । এই রাজকীয় খেলা বেচারা বিপিনের পক্ষে সুবিধাজনক হয় নাই। অন্তঃপুরের বিমুখতায় তাহার আহারাদির ব্যবস্থায় পদে পদে কণ্টক পড়িতে লাগিল। ধনীগৃহের । ভৃত্য আশ্রিত ভদ্রলোকের প্রতি স্বভাবতই প্রতিকুল ; তাহারা রানীর আক্রোশে সাহস পাইয়৷ ভিতরে ভিতরে বিপিনকে অনেকপ্রকার উপেক্ষা দেখাইত । রানী একদিন পুটেকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, “তোকে যে কোনো কাজেই পাওয়া যায় না, সমস্ত দিন করিস কী।” সে কহিল, রাজার আদেশে বিপিনবাবুর সেবাতেই তাহার দিন কাটিয়া যায়। রানী কহিলেন, “ইস্, বিপিনবাবু যে ভারি নবাব দেখিতেছি।” পরদিন হইতে পুটে বিপিনের উচ্ছিষ্ট ফেলিয়া রাখিত ; অনেকসময় তাহার অন্ন ঢাকিয়া রাথিত না । অনভ্যস্ত হস্তে বিপিন নিজের অন্নের থালি নিজে মাজিতে লাগিল এবং মাঝে মাঝে উপবাস দিল ; কিন্তু ইহা লইয়া রাজার নিকট নালিশ ফরিয়াদ করা তাহার স্বভাববিরুদ্ধ। কোনো চাকরের সহিত কলহ করিয়া সে আত্মবিমাননা করে নাই । এইরূপে বিপিনের ভাগ্যে সদর হইতে অাদর বাড়িতে লাগিল, অন্দর হইতে অবজ্ঞার সীমা রহিল না। এ দিকে সুভদ্রাহরণ গীতিনাট্য রিহার্শালশেষে প্রস্তুত । রাজবাটির অঙ্গনে তাহার অভিনয় হইল। রাজা স্বয়ং সাজিলেন কৃষ্ণ, বিপিন সাজিলেন অজুন । আহা, অজুনের যেমন কণ্ঠ তেমনি রূপ। দর্শকগণ ধন্য ধন্য’ করিতে লাগিল । রাত্রে রাজা আসিয়া বসন্তকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন অভিনয় দেখিলে।” রানী কহিলেন, “বিপিন তো বেশ অজুন সাজিয়াছিল। বড়োঘরের ছেলের মতো তাহার চেহারা বটে, এবং গলার স্বরটিও তো দিব্য ।” রাজা বলিলেন, “আর, আমার চেহারা বুঝি কিছুই নয়, গলাটাও বুঝি মন্দ ।” রানী বলিলেন, “তোমার কথা আলাদা।” বলিয়া পুনরায় বিপিনের অভিনয়ের কথা পাড়িলেন ।