পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२b” রবীন্দ্র-রচনাবলী অমল কহিল, "দাদাকে একবার দেখাতে হবে।” শুনিয়া চারু পান সাজা ফেলিয়া আসন হইতে বেগে উঠিয়া পড়িল ; খাতা কাড়িবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, তাকে শোনাতে পাবে না। তাকে যদি আমার লেখার কথা বল তা হলে আমি আর এক অক্ষর লিখব না।” অমল। বউঠান, তুমি ভারি ভুল বুঝছ। দাদা মুখে যাই বলুন, তোমার লেখা দেখলে খুব খুশি হবেন । চারু । তা হোক, আমার খুশিতে কাজ নেই। চারু প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়াছিল সে লিখিবে— অমলকে আশ্চর্য করিয়া দিবে ; মন্দার সহিত তাহার যে অনেক প্রভেদ এ কথা প্রমাণ না করিয়া সে ছাড়িবে না। এ কয়দিন বিস্তর লিখিয়া সে ছিড়িয়া ফেলিয়াছে। যাহা লিখিতে যায় তাহ নিতান্ত অমলের লেখার মতো হইয়া উঠে ; মিলাইতে গিয়া দেখে এক-একটা অংশ আমলের রচনা হইতে প্রায় অবিকল উদ্ভূত হইয়া আসিয়াছে। সেইগুলিই ভালো, বাকিগুলা কঁচা । দেখিলে অমল নিশ্চয়ই মনে মনে হাসিবে, ইহাই কল্পনা করিয়া চারু সে-সকল লেখা কুটি কুটি করিয়া ছিড়িয়া পুকুরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে, পাছে তাহার একটা খণ্ডও দৈবাৎ অমলের হাতে আসিয়া পড়ে । ஆ প্রথমে সে লিখিয়াছিল ‘শ্রাবণের মেঘ’ । মনে করিয়াছিল, ‘ভাবাশ্র জলে অভিষিক্ত খুব একটা নূতন লেখা লিখিয়াছি।’ হঠাৎ চেতনা পাইয়া দেখিল জিনিসটা অমলের ‘আষাঢ়ের চাদ’-এর এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। অমল লিখিয়াছে, ‘ভাই চাদ, তুমি মেঘের মধ্যে চোরের মতে লুকাইয়া বেড়াইতেছ কেন । চারু লিখিয়াছিল, সখী কাদম্বিনী, হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া তোমার নীলাঞ্চলের তলে চাদকে চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছ’ ইত্যাদি । কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চারু রচনার বিষয় পরিবর্তন করিল। চাদ, মেঘ, শেফালি, বউ-কথা-কও, এ-সমস্ত ছাড়িয়া সে “কালীতলা’ বলিয়। একটা লেখা লিখিল । তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পুকুরটির ধারে কালীর মন্দির ছিল ; সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র স্মৃতি, সেই জাগ্রত ঠাকুরানীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গ্রামে চিরপ্রচলিত প্রাচীন গল্প— এই-সমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল । তাহার আরম্ভ-ভাগ অমলের লেখার ছাদে কাব্যাড়ম্বরপূর্ণ হইয়াছিল, কিন্তু খানিকটা অগ্রসর হইতেই তাহার লেখা সহজেই সরল এবং পল্লীগ্রামের ভাষা-ভঙ্গী-আভাসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।