পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९१४ রবীন্দ্র-রচনাবলী পটল । বড়ো কৰ্মই করে। গোড়ায় হার না মানিয়া শেষে হার মানিলে কত খুশি হইতাম । রাত্রে শোবার ঘরের জানলা-দরজা খুলিয়া দিয়া যতীন অনেক কথা ভাবিল। যে মেয়ে আপনার বাপ-মাকে না খাইতে পাইয়া মরিতে দেখিয়াছে, তাহার জীবনের উপর কী ভীষণ ছায়া পড়িয়াছে। এই নিদারুণ ব্যাপারে সে কত বড়ো হইয়া উঠিয়াছে – তাহাকে লইয়া কি কৌতুক করা যায়। বিধাতা দয়া করিয়া তাহার বুদ্ধিবৃত্তির উপরে একটা আবরণ ফেলিয়া দিয়াছেন– এই আবরণ যদি উঠিয়া যায় তবে অদৃষ্টের রুদ্রলীলার কী ভীষণ চিহ্ন প্রকাশ হইয়া পড়ে। আজ মধ্যাহ্নে গাছের ফাক দিয়া যতীন যখন ফাস্তুনের আকাশ দেখিতেছিল, দূর হইতে কাঠালমুকুলের গন্ধ মুদ্রতর হইয় তাহার ভ্রাণকে আবিষ্ট করিয়া ধরিতেছিল, তখন তাহার মনটা মাধুর্যের কুহেলিকায় সমস্ত জগৎটাকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিয়াছিল— ওই বুদ্ধিহীন বালিকা তাহার হরিণের মতো চোখ-দুটি লইয়া সেই সোনালি কুহেলিকা অপসারিত করিয়া দিয়াছে ; ফাঙ্কনের এই কৃজন-গুঞ্জন-মৰ্মরের পশ্চাতে যে সংসার ক্ষুধাতৃষ্ণাতুর দুঃখকঠিন দেহ লইয়া বিরাট মূতিতে দাড়াইয়া আছে, উদঘাটিত যবনিকার শিল্পমাধুর্যের অন্তরালে সে দেখা দিল । পরদিন সন্ধ্যার সময় কুড়ানির সেই বেদন ধরিল। পটল তাড়াতাড়ি যতীনকে ডাকিয়া পাঠাইল । যতীন আসিয়া দেখিল, কষ্টে কুড়ানির হাতে পায়ে খিল ধরিতেছে, শরীর আড়ষ্ট । যতীন ঔষধ আনিতে পাঠাইয়া বোতলে করিয়া গরম জল আনিতে হুকুম করিল। পটল কহিল, “ভারি মস্ত ডাক্তার হইয়াছ, পায়ে একটু গরম তেল মালিশ করিয়া দাও-না। দেখিতেছ না, পায়ের তেলে৷ হিম হইয়া গেছে।” যতীন রোগিণীর পায়ের তলায় গরম তেল সবেগে ঘষিয়া দিতে লাগিল । চিকিৎসা-ব্যাপারে রাত্রি অনেক হইল। হরকুমার কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া বারবার কুড়ানির খবর লইতে লাগিলেন। যতীন বুঝিল, সন্ধ্যাবেলায় কর্ম হইতে ফিরিয়া আসিয়া পটল-অভাবে হরকুমারের অবস্থা অচল হইয়া উঠিয়াছে— ঘন ঘন কুড়ানির খবর লইবার তাৎপর্য তাই। যতীন কহিল, “হরকুমারবাবু ছট্‌ফট্‌ করিতেছেন, তুমি যাও পটল ।” পটল কহিল, “পরের দোহাই দিবে বৈকি। ছট্‌ফট্‌ কে করিতেছে তা বুঝিয়াছি। আমি গেলেই এখন তুমি বঁাচে । এ দিকে কথায় কথায় লজ্জায় মুখচোখ লাল হইয়া উঠে– তোমার পেটে যে এত ছিল, তা কে বুঝিবে।” যতীন। আচ্ছা, দোহাই তোমার, তুমি এইখানেই থাকো। রক্ষা করে।—