পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । ৩৭৯ অধিক দুঃখ পাইতে হয় নাই। রাসমণির অনেক বয়স পর্যন্ত সস্তান হয় নাই— এই তাহার অকৰ্মণ্য সরলপ্রকৃতি পরমুখাপেক্ষী স্বামীটিকে লইয়া তাহার পত্নীপ্রেম ও মাতৃস্নেহ দুই মিটিয়াছিল। ভবানীকে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত বালক বলিয়াই দেখিতেন। কাজেই শাশুড়ির মৃত্যুর পর হইতে বাড়ির কর্তা এবং গৃহিণী উভয়েরই কাজ তাহাকে একলাই সম্পন্ন করিতে হইত। গুরুঠাকুরের ছেলে এবং অন্যান্ত বিপদ হইতে স্বামীকে রক্ষা করিবার জন্ত তিনি এমনি কঠোরভাবে চলিতেন যে, তাহার স্বামীর সঙ্গীর। র্তাহাকে ভারি ভয় করিত। প্রখরতা গোপন করিয়া রাখিবেন, স্পষ্ট কথাগুলার ধারটুকু একটু নরম করিয়া দিবেন, এবং পুরুষমণ্ডলীর সঙ্গে যথোচিত সংকোচ রক্ষা করিয়া চলিবেন, সেই নারীজনোচিত সুযোগ তাহার ঘটিল না। এ পর্যন্ত ভবানীচরণ র্তাহার বাধ্যভাবেই চলিতেছিলেন। কিন্তু কালীপদর সম্বন্ধে রাসমণিকে মানিয়া চলা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিল। তাহার কারণ এই, রাসমণি ভবানীর পুত্রটিকে ভবানীচরণের নজরে দেখিতেন না। তাহার স্বামীর সম্বন্ধে তিনি ভাবিতেন, বেচারা করিবে কী, উহার দোষ কী, ও বড়োমানুষের ঘরে জন্মিয়াছে— ওর তো উপায় নাই। এইজন্য র্তাহার স্বামী যে কোনোরূপ কষ্ট স্বীকার করিবেন, ইহা তিনি আশাই করিতে পারিতেন না। তাই সহস্ৰ অভাব সত্ত্বেও প্রাণপণ শক্তিতে তিনি স্বামীর সমস্ত অভ্যস্ত প্রয়োজন যথাসম্ভব জোগাইয়া দিতেন। তাহার ঘরে বাহিরের লোকের সম্বন্ধে হিসাব খুবই কষা ছিল, কিন্তু ভবানীচরণের আহারে ব্যবহারে পারতপক্ষে সাবেক নিয়মের কিছুমাত্র ব্যত্যয় হইতে পারিত না। নিতান্ত টানাটানির দিনে যদি কোনো বিষয়ে কিছু ক্রটি ঘটিত তবে সেটা যে অভাববশত ঘটিয়াছে সে কথা তিনি কোনোমতেই স্বামীকে জানিতে দিতেন না— হয়তো বলিতেন, “ওই রে, হতভাগা কুকুর খাবারে মুখ দিয়া সমস্ত নষ্ট করিয়া দিয়াছে ? বলিয়া নিজের কল্পিত অসতর্কতাকে ধিকৃকার দিতেন। নয়তে লক্ষ্মীছাড়া নোটোর দোষেই নূতন-কেনা কাপড়টা খোওয়া গিয়াছে বলিয়া তাহার বুদ্ধির প্রতি প্রচুর অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিতেন— ভবানীচরণ তখন তাহার প্রিয় ভৃত্যটির পক্ষাবলম্বন করিয়া গৃহিণীর ক্রোধ হইতে তাহাকে বঁাচাইবার জন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন । এমন-কি, কখনো এমনও ঘটিয়াছে, যে কাপড় গৃহিণী কেনেন নাই এবং ভবানীচরণ চক্ষেও দেখেন নাই এবং যে কাল্পনিক কাপড়খান হারাইয়া ফেলিয়াছে বলিয়া নটবিহারী অভিযুক্ত— ভবানীচরণ অমানমুখে স্বীকার করিয়াছেন যে, সেই কাপড় নোটো তাহাকে কোচাইয়া দিয়াছে, তিনি তাহা পরিয়াছেন এবং তাহার পর— তাহার পর কী হইল সেটা হঠাৎ তাহার কল্পনাশক্তিতে জোগাইয়া উঠে নাই— রাসমণি