পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন রসের ধর্ম আমাদের ধর্মসাধনার দুটো দিক আছে, একটা শক্তির দিক, একটা রসের দিক। পৃথিবী যেমন জলে স্থলে বিভক্ত, এও ঠিক তেমনি । শক্তির দিক হচ্ছে বলিষ্ঠ বিশ্বাস। এ বিশ্বাস জ্ঞানের সামগ্রী নয়। ঈশ্বর আছেন, এইটুকু মাত্র বিশ্বাস করাকে বিশ্বাস বলি নে। আমি যার কথা বলছি, এই বিশ্বাস সমস্ত চিত্তের একটি অবস্থা ; এ একটি অবিচলিত ভরসার ভাব। মন এতে ধ্রুব হয়ে অবস্থিতি করে— আপনাকে সে কোনো অবস্থায় নিরাশ্রয় নিঃসহায় মনে করে না । এই বিশ্বাস জিনিসটি পৃথিবীর মতো দৃঢ়। এ একটি নিশ্চিত আধার। এর মধ্যে মস্ত একটি জোর আছে। যার মধ্যে এই বিশ্বাসের বল নেই, অর্থাৎ যার চিত্তে এই ধ্রুব স্থিতিতত্ত্বটির অভাব আছে, সে ব্যক্তি সংসারে ক্ষণে ক্ষণে যা-কিছুকে হাতে পায়, তাকে অত্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টায় অঁাকড়ে ধরে । সে ষেন অতল জলে পড়েছে— কোথাও সে পায়ের কাছে মাটি পায় না ; এইজন্যে যে-সব জিনিস সংসারের জোয়ারে ভাটায় ভেসে আসে ভেসে চলে যায়, তাদেরি তাড়াতাড়ি দুই মুঠো দিয়ে চেপে ধরাকেই সে পরিত্রাণ বলে মনে করে। তার মধ্যে যা-কিছু হারায়, যা-কিছু তার মুঠো ছেড়ে চলে যায়, তার ক্ষতিকে এমনি সে একান্ত ক্ষতি বলে মনে করে ষে, কোথাও সে সাত্ত্বনা খুজে পায় না। কথায় কথায় কেবলি তার মনে হয়, সর্বনাশ হয়ে গেল । বাধাবিঘ্ন কেবলি তার মনে নৈরাশ্র্য ঘনীভূত করে তোলে। সেই-সমস্ত বিঘ্নকে পেরিয়ে সে কোথাও একটা চরম সফলতার নিঃসংশয় মুর্তি দেখতে পায় না। যে-লোক ডুবজলে সাতার দেয় যার কোথাও দাড়াবার উপায় নেই, সামান্ত হাড়ি কলসি কলার ভেলা তার পরমধন— তার ভয় ভাবনা উদ্বেগের সীমা নেই। আর, যে-ব্যক্তির পায়ের নিচে স্থদূঢ় মাটি আছে, তারো হাড়িকলসির প্রয়োজন আছে, কিন্তু হাড়িকলসি তার জীবনের অবলম্বন নয়— এগুলো যদি কেউ কেড়ে নেয় তাহলে তার যতই অভাব অস্থবিধা হ’ক না, সে ডুবে মরবে না ।