পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৩২ ৷ রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘরের লোকের কাছে তারাপ্রসন্নের ভাব অন্যরূপ ; এমন কি, তাহার নিজের স্ত্রী দীক্ষায়ণীও র্তাহার সহিত কথায় অঁাটিয়া উঠিতে পারেন না। গৃহিণী কথায় কথায় বলেন, “নেও নেও, আমি হার মানলুম। আমার এখন অন্য কাজ আছে।” বাগযুদ্ধে স্ত্রীকে আত্মমুখে পরাজয় স্বীকার করাইতে পারে, এমন ক্ষমতা এবং এমন সৌভাগ্য কয়জন স্বামীর আছে । তারাপ্রসঙ্কের দিন বেশ কাটিয়া যাইতেছে। দাক্ষায়ণীর দৃঢ় বিশ্বাস, বিদ্যাৰুদ্ধিক্ষমতায় তাহার স্বামীর সমতুল্য কেহ নাই এবং সে-কথা তিনি প্রকাশ করিয়া বলিতেও কুষ্ঠিত হইতেন না ; শুনিয়া তারাপ্রসন্ন বলিতেন, “তোমার একটি বই স্বামী নাই, তুলনা কাহার সহিত করিবে।” শুনিয়া দাক্ষায়ণী ভারি রাগ করিতেন। দাক্ষায়ণীর কেবল একটা এই মনস্তাপ ছিল যে, তাহার স্বামীর অসাধারণ ক্ষমতা বাহিরে প্রকাশ হয় না,— স্বামীর সে-সম্বন্ধে কিছুমাত্র চেষ্টা নাই। তারাপ্রসন্ন যাহা লিখিতেন তাহা ছাপাইতেন না । অনুরোধ করিয়া দীক্ষায়ণী মাঝে-মাঝে স্বামীর লেখা শুনিতেন, যতই না বুঝিতেন ততই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন। তিনি কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণ-চণ্ডী পড়িয়াছেন এবং কথকতাও শুনিয়াছেন। সে-সমস্তই জলের মতো বুঝা যায়, নিরক্ষর লোকেও অনায়াসে বুঝিতে পারে, কিন্তু তাহার স্বামীর মতো এমন সম্পূর্ণ দুর্বোধ হইবার আশ্চর্য ক্ষমতা তিনি ইতিপূর্বে দেখেন নাই । তিনি মনে-মনে কল্পনা করিতেন, এই বই যখন ছাপানো হইবে এবং কেহ এক অক্ষর বুঝিতে পারিবে না, তখন দেশমৃদ্ধ লোক বিস্ময়ে কিরূপ অভিভূত হইয়া যাইবে । সহস্রবার করিয়া স্বামীকে বলিতেন, “এ-সব লেখা ছাপাও ।” স্বামী বলিতেন, “বই ছাপানো সম্বন্ধে ভগবান মনু স্বয়ং বলে গেছেন, প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফল ।” 影 তারাপ্রসম্নের চারিটি সস্তান, চারই কন্যা। দীক্ষায়ণী মনে করিতেন সেটা গর্ভধারিণীরই অক্ষমতা । এইজন্য তিনি আপনাকে প্রতিভাসম্পন্ন স্বামীর অত্যন্ত অযোগ্য স্ত্রী মনে করিতেন। ষে-স্বামী কথায় কথায় এমন-সকল দুরূহ গ্রন্থ রচনা করেন, তাহার স্ত্রীর গর্ভে কন্যা বই আর সস্তান হয় না, স্ত্রীর পক্ষে এমন অপটুতার পরিচয় আর কী দিব । প্রথম কন্যাটি যখন পিতার বক্ষের কাছ পর্যন্ত বাড়িয়া উঠিল, তখন তারাপ্রসম্নের নিশ্চিন্তভাব ঘুচিয়া গেল। তখন তাহার স্মরণ হইল, একে একে চারিটি কন্যারই