পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 8ግቖ এমনি পদে পদে দেখতে পাচ্ছি, জগতের রাজা আমাকে খুশী করবার জন্য র্তার বহুলক্ষ যোজনান্তরেরও অনুচরপরিচরদের হুকুম দিয়ে রেখেছেন ; তাদের সকল কাজের মধ্যে এটাও তারা ভুলতে পারে না। এ জগতে আমার মূল্য সামান্ত নয়। কিন্তু মুখের আয়োজনের মধ্যেই যখন নিঃশেষে প্রবেশ করতে চাই, তখন আবার কে আমাদের হাত চেপে ধরে, বলে যে, ‘তোমাকে বদ্ধ হতে দেব না। এই-সমস্ত স্বথের সামগ্রীর মধ্যে ত্যাগী হয়ে, মুক্ত হয়ে তোমাকে থাকতে হবে, তবেই এই আয়োজন সার্থক হবে । শিশু যেমন গর্ভ থেকে মুক্ত হয়ে তবেই যথার্থভাবে সম্পূর্ণভাবে সচেতনভাবে তার মাকে পায়, তেমনি এই-সমস্ত সুখের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন মঙ্গললোকে মুক্তিলোকে ভূমিষ্ঠ হবে, তখনি সমস্তকে পরিপুর্ণরূপে পাবে। যখনি আসক্তির পথে যাবে তখনি সমগ্রকে হারাবার পথেই যাবে— বস্তুকে যথনি চোখের উপরে টেনে আনবে, তখনি তাকে আর দেখতে পাবে না, তখনি চোখ অন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের পিতা সুখের মধ্যে আমাদের বদ্ধ হতে দেন না, কেননা সমগ্রের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হতে হবে— এবং সেই যোগের মধ্য দিয়েই র্তার সঙ্গে আমার সত্য যোগ । এই সমগ্রের সঙ্গে যাতে আমাদের যোগসাধন করে তাকেই বলে মঙ্গল । এই মঙ্গলবোধই মানুষকে কিছুতেই সুখের মধ্যে স্থির থাকতে দিচ্ছে না— এই মঙ্গলবোধই পাপের বেদনায় মানুষকে এই কান্না কাদাচ্ছে— মা মা হিংসীঃ, বিশ্বানি দেব সবিতরদুরিতানি পরাস্তব, যদুভদ্রং তন্ন আস্থব । সমস্ত খাওয়াপরার কান্না ছাড়িয়ে এই কান্না উঠেছে, “আমাকে দ্বন্দ্বের মধ্যে রেখে আর আঘাত কোরো না, আমাকে পাপ থেকে মুক্ত করে ; আমাকে সম্পূর্ণ তোমার মধ্যে আনন্দে নত করে দাও।” তাই মানুষ এই বলে নমস্কারের সাধনা করছে, নমঃ শস্তবায় চ ময়োভবায় চ– সেই সুখকর যে তাকেও নমস্কার, আর সেই কল্যাণকর যে তাকেও নমস্কার-– একবার মাতারূপে তাকে নমস্কার, একবার পিতারূপে তাকে নমস্কার । মানবজীবনের দ্বন্দ্বের দোলার মধ্যে চড়ে যেদিকেই হেলি সেইদিকে তাকেই নমস্কার করতে শিখতে হবে । তাই বলি, নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ– সুখের আকর যিনি তাকেও নমস্কার, মঙ্গলের আকর যিনি তাকেও নমস্কার— মাতা যিনি সীমার মধ্যে বেঁধে ধারণ করছেন, পালন করছেন, র্তাকেও নমস্কার, আর পিতা যিনি বন্ধন ছেদন করে অসীমের মধ্যে আমাদের পদে পদে অগ্রসর করছেন, তাকেও নমস্কার। অবশেষে দ্বিধা অবসান হয় যখন সব নমস্কার একে এসে মেলে— তখন নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ– তখন সুখে মঙ্গলে আর ভেদ