পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S९ রবীন্দ্র-রচনাবলী রকম হয়, এই গওগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে র্তাহার আপিস ; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারিপাড়ে জঙ্গল । কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে। বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না । অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে । এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই । কখনো-কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্তদিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায়— কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহ হইলে এই আধমরা ভদ্রসস্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে। পোস্টমাস্টারের বেতন অতি সামান্য । নিজে রণধিয়া থাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালিকা তাহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি থাইতে পায় । মেয়েটির নাম রতন । বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না । সন্ধ্যার সময় যখন গ্রামের গোয়ালঘর হইতে ধূম কুগুলায়িত হইয়া উঠিত, ঝোপে ঝোপে ঝিল্লি ডাকিত, দূরে গ্রামের নেশাথোর বাউলের দল খোলকরতাল বাজাইয়া উচ্চৈঃস্বরে গান জুড়িয়া দিত— যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত, তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জালিয়া পোস্টমাস্টার ডাকিতেন ‘রতন’। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকে ঘরে আসিত না— বলিত, “কী গ৷ বাবু, কেন ডাকছ ।” পোস্টমাস্টার । তুই কী করছিস । রতন। এখনি চুলে ধরাতে যেতে হবে— হেঁশেলের— পোস্টমাস্টার । তোর হেশেলের কাজ পরে হবে এখন— একবার তামাকটা সেজে দে তো । অনতিবিলম্বে দুটি গাল ফুলাইয়া কলিকায় ফু দিতে দিতে রতনের প্রবেশ। হাত হইতে কলিকাটা লইয়া পোস্টমাস্টার ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা রতন, তোর