পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (ζ ο Σ এইজন্য জীবনের মধ্যে তিনি সেই ব্রহ্মকে গ্রহণ করলেন — পরিমিত পদার্থের মতো করে র্যাকে পাওয়া যায় না এবং শূন্তপদার্থের মতে র্যাকে না-পাওয়া যায় না— বাকে পেতে গেলে একদিকে জ্ঞানকে খর্ব করতে হয় না, অন্যদিকে প্রেমকে উপবাসী করে মারতে হয় না— যিনি বস্তুবিশেষের দ্বারা নির্দিষ্ট নন অথবা বস্তুশূন্ততার দ্বারা অনির্দিষ্ট নন— যার সম্বন্ধে উপনিষদ বলেছেন যে, যে তাকে বলে আমি জানি সেও তাকে জানে না, যে বলে আমি জানি নে সেও তাকে জানে। এক কথায় র্যার সাধনা হচ্ছে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্তের সাধনা ৷ র্যারা মহৰ্ষির জীবনী পড়েছেন তারা সকলেই দেখেছেন, ভগবৎপিপাসা যখন র্তার প্রথম জাগ্রত হয়ে উঠেছিল তখন কি-রকম দুঃসহ বেদনার মধ্যে র্তার হৃদয়কে তরঙ্গিত করে তুলেছিল। অথচ তিনি যখন ব্রহ্মানন্দের রসাস্বাদ করতে লাগলেন তখন তাকে উদ্দাম ভাবোন্মাদে আত্মবিস্মৃত করে দেয় নি। কারণ, তিনি র্যাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি শাস্তম শিবম অদ্বৈতম– তার মধ্যে সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত প্রেম অতলম্পর্শ পরিপূর্ণতায় পর্যাপ্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে বিশ্বচরাচর শক্তিতে ও সৌন্দর্যে নিত্যকাল তরঙ্গিত হচ্ছে— সে তরঙ্গ সমুদ্রকে ছাড়িয়ে চলে যায় না, এবং সমুদ্র সেই তরঙ্গের দ্বারা আপনাকে উদ্‌বেল করে তোলে না। র্তার মধ্যে অনন্ত শক্তি বলেই শক্তির সংযম এমন অটল, অনন্ত রস বলেই রসের গাম্ভীর্য এমন অপরিমেয় । এই শক্তির সংযমে এই রসের গাম্ভীর্যে মহর্ষি চিরদিন আপনাকে ধারণ করে রেখেছিলেন, কারণ, ভূমার মধ্যেই আত্মাকে উপলব্ধি করবার সাধনা তার ছিল। ধারা আধ্যাত্মিক অসংযমকেই আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় বলে মনে করেন র্তারা এই অবিচলিত শান্তির অবস্থাকেই দারিদ্র্য বলে কল্পনা করেন, তারা প্রমত্ততার মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়াকেই ভক্তির চরম অবস্থা বলে জানেন । কিন্তু র্যারা মহর্ষিকে কাছে থেকে দেখেছেন, বস্তুত র্যারা কিছুমাত্র তার পরিচয় পেয়েছেন, তারা জানেন যে র্তার প্রবল সংযম ও প্রশান্ত গাম্ভীর্য ভক্তিরসের দীনতাজনিত নয়। প্রাচীন ভারতের তপোবনের ঋষিরা যেমন র্তার গুরু ছিলেন, তেমনি পারস্যের সৌন্দর্যকুঞ্জের বুলবুল হাফেজ তার বন্ধু ছিলেন। তার জীবনের আনন্দপ্রভাতে উপনিষদের শ্লোকগুলি ছিল প্রভাতের আলোক এবং হাফেজের কবিতাগুলি ছিল প্রভাতের গান। হাফেজের কবিতার মধ্যে যিনি আপনার রসোচ্ছ্বাসের সাড়া পেতেন, তিনি যে তার জীবনেশ্বরকে কি-রকম নিবিড় রসবেদনাপুর্ণ মাধুর্যঘন প্রেমের সঙ্গে অস্তরে বাহিরে দেখেছিলেন, সে কথা অধিক করে বলাই বাহুল্য।