রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/৬

উইকিসংকলন থেকে

(৬)

ধর্ম্মমাণিক্য ও রাজমালা

 মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্য রত্নমাণিক্যের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ। মহামাণিক্যের পাঁচ পুত্র ছিল। তন্মধ্যে ধর্ম্মই জ্যেষ্ঠ, যৌবনের সঙ্গেই ধর্ম্মের বৈরাগ্য উপস্থিত হয়। তিনি সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া যান এবং তীর্থে তীর্থে ঘুরিয়া অবশেষে কাশীধামে উপনীত হন। একদিন পথশ্রান্ত হইয়া তিনি মণিকর্ণিকা ঘাটের বৃক্ষমূলে নিদ্রিত আছেন এমন সময় এক সর্প তাঁহার মাথার উপর ফনা ধরিয়া রৌদ্র নিবারণ করিতেছিল। এই দৃশ্য কান্যকুব্জবাসীয় এক ব্রাহ্মণ দেখিতে পাইয়া ব্যস্ত হইয়া সন্ন্যাসীকে জাগাইলেন। ব্রাহ্মণ ধর্ম্মের পরিচয় জানিতে চাহিলে ধর্ম্ম বলিলেন, তিনি সুদূর ত্রিপুরা হইতে আসিয়াছেন। ব্রাহ্মণ বলিলেন—“হে কুমার, তুমি দেশে ফিরিয়া যাও, তোমার জন্য রাজমুকুট অপেক্ষায় রহিয়াছে।” ধর্ম্ম বলিলেন—“আমি যাইতে পারি যদি আপনার ন্যায় ব্রাহ্মণ আমার অনুগমন করেন।” ব্রাহ্মণ সম্মত হইলেন। এদিকে ত্রিপুরার লোক ধর্ম্মকে খুঁজিতে আসিয়া কাশীধামে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া বলিল—“কুমার, তুমি সন্ন্যাসী হইয়া দেশে দেশে ফিরিতেছ আর আমরা তোমাকে খুঁজিয়া মরিতেছি, দেশের জন্য তোমার বিন্দু মাত্র টান নাই।” কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন—“কেন কি হইয়াছে?” তাহারা বলিল—“তোমার পিতা মহামাণিক্য স্বর্গীয় হইয়াছেন, এ দিকে তোমার চারি ভাই সকলেই সিংহাসন চান, সেনাপতিরাও স্ব স্ব প্রধান, তারাও রাজা হইতে চায়, এইভাবে রাজ্যে ঘোর অশান্তি। পাত্র মিত্র সব মন্ত্রণা করিয়া আমাদিগকে তোমাকে খুঁজিতে পাঠাইয়াছে, এখন তুমি যদি রাজ্যে ফিরিয়া আস তবেই সব দিক রক্ষা হয় নতুবা ত্রিপুরা রাজ্যে রক্তনদী বহিয়া যাইবে। ত্রিপুরাকে শ্মশান করিতে চাও, না দেশে দেশে সন্ন্যাসী হইয়া ফিরিতে চাও?”

 কথাগুলি একতিলও মিথ্যা নহে, তবে ত কনোজী ব্রাহ্মণ ঠিকই বলিয়াছেন যে রাজমুকুট আমার জন্য অপেক্ষায় আছে! এ ব্রাহ্মণ মনুষ্য না দেবতা! এইরূপ চিন্তা করিয়া ধর্ম্ম স্বরাজ্যে যাইতে স্বীকার করিলেন। তখন কনোজী ব্রাহ্মণকে এ সব জানাইলেন। ধর্ম্মের আগ্রহে আট জন ব্রাহ্মণ তাঁহার সহগামী হইলেন, জ্বলন্ত পাবক তুল্য এই ব্রাহ্মণগণের সাহচর্য্য পাইয়া হয়ত ধর্ম্মের মন তপস্যা হইতে সংসারের পথে ফিরিতে সম্মত হইয়াছিল। দীর্ঘকাল পরে যখন ধর্ম্ম স্ব-রাজ্য সীমায় পদার্পণ করিলেন তখন এ শুভ-সংবাদ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। প্রজারা দলে দলে সন্ন্যাসী ধর্ম্মকে দেখিতে আসিল। আজিকার দিনে ভাওয়াল সন্ন্যাসীকে দেখিতে যেরূপ জনসমুদ্র ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল হয়ত সেইরূপ সে সময় ঘটিয়া থাকিবে। দুর্গ খালি ফেলিয়া সকল সৈন্য সন্ন্যাসী ধর্ম্মকে আগু বাড়াইয়া নিতে আসিল। সেনাপতিদের রাজ্যলোভের নেশা ছুটিয়া গেল, তাহারাও সৈন্যদের সহিত যোগ দিল। কুচক্রী চারি ভাইয়ের দুঃস্বপ্ন কাটিয়া গেল, তাহারা ত্বরিতে ধর্ম্মকে অভ্যর্থনা করিতে ছুটিয়া আসিল। সেনাপতিরা ধর্ম্মের পায়ে লুটাইয়া পড়িল। তখন ধর্ম্ম তাঁহার অনুজ চারি ভাইকে আলিঙ্গন করিলেন। সকলেরই চক্ষুতে আনন্দের অশ্রু বহিতে লাগিল। আকাশ ভরিয়া মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্যের জয়ধ্বনি ঘোষিত হইল। এমনি করিয়া বিপদের মহানিশা কাটিয়া গিয়া সুখের সূর্য্যোদয় হইল।

 শুভদিনে ধর্ম্মমাণিক্যের অভিষেক হইল, পুরবাসীর আর আনন্দ ধরে না। ধর্ম্ম নামের সার্থকতার মধ্যে তাঁহার জীবন ফুটিয়া উঠিয়াছিল। কুমিল্লার ধর্ম্মসাগর আজও তাঁহার পুণ্যকীর্ত্তি ঘোষণা করিতেছে। পুণ্য দিনে এই উত্তম জলাশয় উৎসর্গ কালে কনোজী ব্রাহ্মণগণকে উহার পারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া বহু ভূমি দান করেন। তাম্রশাসনে এই কথা লিখিয়া দেন—“আমার বংশ যদি লোপ পায় এবং এই রাজ্য অন্য রাজার হস্তে চলিয়া যায় তবে আমি সেই রাজার দাসানুদাস হইব যদি তিনি ব্রহ্মবৃত্তি লোপ না করেন।”

 মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্যের বীরত্বের তুলনা নাই। তিনি যেমন ধার্ম্মিক তেমন বীর ছিলেন। মুসলমানদের প্রতাপ বঙ্গের প্রায় সর্ব্বত্র বাড়িয়া চলিল, অবশেষে ধর্ম্মমাণিক্য বাঙ্গালা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তাঁহার জয় হইল, বঙ্গের নবাব হঠিয়া গেলেন। তিনি ত্রিপুর রাজগণের আদি বাসস্থান সোনার গাঁ লুণ্ঠন করিয়া স্ব-রাজ্যে ফিরিয়া আসেন। ঐ সময়ে ব্রহ্মরাজ আরাকান
মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্য বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর নামক পুরোহিতদ্বয়ের দ্বারা রাজমালা কবিতায় রচনা করান।
পতিকে যুদ্ধে হারাইয়া রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দেন। মঘরাজ ত্রিপুর রাজের নিকট আশ্রয় ভিক্ষা করেন। প্রবল পরাক্রম ধর্ম্মমাণিক্যের শক্তিতে মঘরাজ পুনরায় নিজ রাজ্য ফিরিয়া পাইলেন। ব্রহ্মরাজের এই ন্যূনতা ত্রিপুর ইতিহাসের পক্ষে কম গৌরবের বিষয় নহে।

 গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন যোগভ্রষ্ট কখনো কখনো উত্তম ঘরে জন্মায়। ধর্ম্মমাণিক্য যোগভ্রষ্ট পুরুষ তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার রাজত্বের অক্ষয় কীর্ত্তি রাজমালা বিরচন। তিনি পিতৃপুরুষদিগের ধারাবাহিক ইতিহাস বাণেশ্বরশুক্রেশ্বর নামক পুরোহিত দ্বয়ের দ্বারা কবিতায় রচনা করান।[১] এই গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষার অমূল্য সম্পদ। খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই গ্রন্থ লেখা হয়। ৩২ বৎসর রাজত্ব করার পর তিনি স্বর্গে গমন করেন। ধর্ম্মমাণিক্যের রাজত্বকাল ১৪৩০ হইতে ১৪৬২ খ্রীষ্টাব্দ ধরা যাইতে পারে।

  1. বাণেশ্বরশুক্রেশ্বর শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্গত ঢাকা দক্ষিণ পরগণার ঠাকুরবাড়ী গ্রামনিবাসী, ইহারা ব্রাহ্মণ, উপাধি চক্রবর্ত্তী।