রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৩

উইকিসংকলন থেকে


(৩)

কল্যাণমাণিক্যের অভিষেক

 মহারাজ যশোধরমাণিক্য প্রবাসে জীবনযাপন করিতে লাগিলেন, আর এদিকে উদয়পুরে কষ্টের সীমা রহিল না। অবরোধকারী মোগলসৈন্যের অত্যাচারে লোকজন অতিষ্ঠ হইয়া পড়িল। উৎপীড়িত হইয়া যাহারা অতি কষ্টে টিকিয়াছিল তাহারাও পলায়ন করিতে লাগিল। দেবকার্য্যে মোগলেরা বাধা দিতে লাগিল, চতুর্দ্দশ দেবতার মন্দিরে ও কালিকা দেবীর মন্দিরে আর শঙ্খঘণ্টা বাজে না, সকাল সন্ধ্যার সুমধুর আরতিধ্বনি দিগ্‌দিগন্ত প্লাবিত করেনা। ধূপধুনার গন্ধে মন্দির আমোদিত হইয়া উঠেনা। ধনরত্নের আশে মোগলেরা উদয়পুরের স্ফটিক-স্বচ্ছ সরোবর হইতে জল বাহির করিয়া এগুলিকে শুকাইয়া ফেলিতে লাগিল। কি নিদারুণ অর্থশোষ! ধনরত্ন বাহির হইল না কিন্তু মহামারীর করাল মূর্ত্তি প্রকট হইয়া উঠিল, দলে দলে মোগলেরা মরিতে লাগিল, পথে ঘাটে মরিয়া পড়িতে লাগিল। মড়ক বুভুক্ষু রাক্ষসের ন্যায় লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করিয়া মোগল ফৌজ গ্রাস করিতে লাগিল। ইহাতে মোগলেরা আতঙ্কিত হইয়া উদয়পুর হইতে অবরোধ তুলিয়া মেহেরকুল[১] (কুমিল্লা) অঞ্চলে চলিয়া গেল।

 আড়াই বৎসর ধরিয়া অরাজক অবস্থা চলিয়াছিল। মোগলদের অবরোধত্যাগে ছত্রভঙ্গ ত্রিপুরবাহিনীর মধ্যে সাড়া পড়িয়া গেল, এ অবস্থায় আর কতদিন? পাত্রমিত্র সভাসদ্ মন্ত্রী ও সেনাপতির আগমনে উদয়পুর পুনরায় মুখরিত হইয়া উঠিল, কাহাকে রাজপদে বসান যায় এই লইয়া জল্পনা কল্পনা চলিতে লাগিল। যশোধরমাণিক্য তখন মথুরায় বানপ্রস্থ অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁহার পুত্র নাই, ভ্রাতা নাই, কেহ নাই যাঁহাকে রাজপদে নির্ব্বাচন করা যায়। তখন মহামাণিক্যের ধারায় জন্ম পুরন্দরপুত্র কল্যাণকেই বসান স্থির হইল। যশোধরমাণিক্যের রাজত্বকালে তিনি কৈলাগড়ে (কসবা) সেনাপতি পদে বৃত ছিলেন। রণক্ষেত্রে নৈপুণ্য দেখাইয়া যশস্বী হন, সুতরাং তাঁহার দিকেই চক্ষু পড়িল। বিধাতা যাঁহার ভালে রাজমুকুট আঁকিয়া দিয়াছেন সকলের চক্ষুই যে তাঁহার উপর পড়িবে তাহাতে বিচিত্র কি?

 ১৬২৬ খৃষ্টাব্দে শুভদিনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা যথারীতি কল্যাণমাণিক্যের অভিষেক কার্য্য সম্পন্ন করিলেন। মঙ্গলবাদ্য বাজনায় রৌশনচৌকির রং পরঙে উদয়পুর ভরিয়া উঠিল, আবার মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খঘণ্টা রব নিনাদিত হইল, চারিদিকেই আনন্দের হিল্লোল, পুর-লক্ষ্মীর আবির্ভাবে নগরী হাসিয়া উঠিয়াছে। অভিষেক সমাধা হইলে ত্রিপুর সেনা মুক্ত কৃপাণে মহারাজকে অভিবাদন করিল। তখন মহারাজ কালিকাপ্রসাদ নামক রাজহস্তী চড়িয়া সহর পরিভ্রমণে বাহির হইলেন। পথে পথে ধনরত্ন বিলাইয়া দেওয়া হইল, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে অকাতরে অর্থদান করা হইল।

 রাজপদে সমাসীন হইয়া কল্যাণমাণিক্য প্রথমেই সেনা বাহিনীর পুনর্গঠনে মন দিলেন। বিচ্ছিন্ন ত্রিপুর সৈন্য পুনরায় তাঁহার রাজচ্ছত্র তলে সমবেত হইল এবং জন্মভূমির উদ্ধার সাধনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া কঠোর অস্ত্রশিক্ষা করিতে লাগিল। এদিকে মহারাজ স্বপ্নে দেখিলেন কালিকাদেবী তাঁহার দেবালয় মূলে সরোবর খননে আদেশ করিতেছেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের পরামর্শ ক্রমে শুভদিনে মহারাজ পুষ্করিণী খনন আরম্ভ করাইলেন, উহাই “কল্যাণসাগর” নামে পরিচিত। ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর মন্দিরের সন্নিহিত পূর্ব্বদিকে ইহা অবস্থিত। মঘ আক্রমণ কালে ঐ মন্দিরের চূড়া শত্রুরা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিল, পুনর্ব্বার মহারাজ উহার সংস্কার সাধন করেন। তৎপর যে সব দীঘি মোগলেরা ধনরত্নের লোভে খাল কাটিয়া শুকাইয়া ফেলিয়াছিল, সেগুলির পুনরুদ্ধার করেন। জলাশয়গুলি নির্ম্মল জলে ভরিয়া উঠায় উদয়পুরের পূর্ব্ব সৌন্দর্য্য ফিরিয়া আসিল এবং স্বাস্থ্যসুখে জলস্থল পূর্ব্ববৎ সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল।

 কল্যাণমাণিক্যের প্রথমা মহিষীর গর্ভে গোবিন্দ ও জগন্নাথ, দ্বিতীয়া মহিষীর গর্ভে নক্ষত্র রায় ও কনিষ্ঠা মহিষীর গর্ভে যাদব ও রাজবল্লভ নামে পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। কুমারেরা যুদ্ধ বিদ্যায় নিপুণ হইয়া উঠিলেন। উদয়পুরের পূর্ব্ব-উত্তর কোণে আচরঙ্গ বহুকালের প্রসিদ্ধ সীমান্তদেশ, গোমতীর উৎপত্তিস্থল ডম্বুরের সন্নিহিত মাইনি পর্ব্বতের পূর্ব্বভাগে আচরঙ্গ নদী আছে—উহা চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে যাইয়া মিশিয়াছে। আচরঙ্গ বহুকাল ত্রিপুরা রাজ্যের সীমারূপে পরিগণিত ছিল। উদয়পুর মোগল অধিকৃত হইলে রণজিৎ সেনাপতি আচরঙ্গ যাইয়া নিজকে রাজা বলিয়া প্রচার করিলেন। কালক্রমে রণজিতের মৃত্যু হইলে তৎপুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ পিতার অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখিতে যত্নশীল হন। ইহাতে কল্যাণমাণিক্যের ক্রোধের সীমা রহিল না, তাঁহার বাহুপাশ এড়াইয়া বিদ্রোহ করা অসীম সাহসের কথা।

 মহারাজের আদেশে গোবিন্দনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণের বিরুদ্ধে অভিযান যাত্রা করিলেন। দুর্গম পর্ব্বত মধ্য দিয়া ত্রিপুরসৈন্য একমাস কাল কাটাইয়া আচরঙ্গ প্রান্তে পৌঁছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ এই বার্ত্তা শুনিয়া ব্যস্তসমস্তে রাজ্য ছাড়িয়া আরও গভীরতর পর্ব্বতে গা ঢাকা দিলেন। সেস্থান আচরঙ্গ হইতে তিন দিনের পথ। আচরঙ্গ গড়ে কিছু সৈন্য রাখিয়া গোবিন্দ নারায়ণ স্বীয় সৈন্য সহকারে লক্ষ্মীনারায়ণকে ঘেরাও করিলেন। ধৃত অবস্থায় লক্ষ্মীনারায়ণকে উদয়পুরে আনা হয়, কল্যাণমাণিক্য অপরাধীকে মার্জ্জনা করেন। আচরঙ্গ দলনের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যমধ্যে স্ব স্ব প্রধান ভাব দূর হইয়া গেল, কল্যাণমাণিক্যের বাহুবলে রাজত্ব সুরক্ষিত হইল। তিনিই কল্যাণপুরের স্থাপয়িতা।

  1. এই সময়ে মোগলগণ ত্রিপুরার সমতলক্ষেত্র অধিকার পূর্ব্বক তাহার বন্দোবস্ত ও রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত করেন। যে সকল পরগণা সামন্ত নরপতি কিম্বা জমিদারদিগের অধিকারভুক্ত ছিল তাহা ত্রিপুরা হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছিল। কয়েকটি পরগণায় মুসলমান জমিদার নিযুক্ত করা হয়। তদ্ব্যতীত যে সকল স্থান মহারাজের খাসদখলে ছিল মোগলগণ তাহাকে “সরকার উদয়পুর” আখ্যা প্রদান পূর্ব্বক নুরনগর, মেহেরকুল প্রভৃতি চারিটি পরগণায় বিভক্ত করিয়া তাহার বার্ষিক রাজস্ব ৯৯,৮৬০ টাকা অবধারণ করেন। প্রায় দুই বৎসর কাল তাঁহারা এইরূপে ত্রিপুরার সমতলক্ষেত্র শাসন করিয়াছিলেন।
    কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা; ৭৭পৃঃ।