রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/১১

উইকিসংকলন থেকে

(১১)

বীরবিক্রমকিশোর

 ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে পিতার মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যুবরাজ বীরবিক্রমকিশোর ১৬ বৎসর বয়সে পিতৃসিংহাসনের অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। ইহা দরবারযোগে ঘোষিত হয়। ইহার কিছুকাল পরে মহারাজ শিক্ষা সমাপন না হওয়ায় বিদেশ বাস করিতে থাকেন। এদিকে রাজ্য Council of Administration যোগে পরিচালিত হইতে থাকে। ১৯২৮ খৃষ্টাব্দে ২৯শে জানুয়ারী মহারাজের অভিষেক কার্য্য মহাসমারোহে শাস্ত্রানুযায়ী সুসম্পন্ন হয়।


মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর
কে, সি, এস, আই।

 মহারাজ সদ্‌গুণরাশিতে ভূষিত এবং প্রতিভাবলে বলীয়ান্। তিনি যুগানুযায়ী নূতনের উপাসক, তাই বলিয়া অতীতের বৈরী নহেন, ইতিহাসের মর্য্যাদা বোধে তাঁহার অন্তর উদ্দীপ্ত।

 রাধাকিশোরমাণিক্যের ন্যায় তিনি যেমন একদিকে বিরাট স্থপতির স্বপ্নে ভরপুর অপরদিকে সাহিত্যানুরাগে তেমনি বঙ্গ সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান্। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে যখন রবীন্দ্রনাথের সত্তর বৎসর পূর্ণ হওয়ায় জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তখন মহারাজ বয়সে নবীন হইলেও সেই মহতী সভার হোতার কার্য্যে বৃত হন। কলিকাতা মহানগরীর টাউন হলের দ্বিতলে এই বিরাট সম্মিলন চলিতেছিল। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা মহারথিগণের মধ্যে মহারাজ দণ্ডায়মান্ হইয়া নিঃসঙ্কোচে কবিসম্রাটকে যে ভাবে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়।

 সাহিত্য রচনায় কোথায় অভিনবত্ব রহিয়াছে মহারাজের চক্ষু এড়াইবার উপায় নাই, এইরূপ চিত্র শিল্পেও তাঁহার দৃষ্টি অসাধারণ। চিত্রকরের উত্তম তুলির টানে যেখানেই নৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে, মহারাজের দৃষ্টি সেইখানে অনায়াসে যাইয়া পড়িয়াছে। সঙ্গীত জগতেও সেই একই কথা। যান্ত্রিক অথবা কণ্ঠ সঙ্গীতে তাঁহার নিকট শিল্পীর সাধনা বিনা বাঁধায় ধরা দিয়া থাকে। ভাবিলে অবাক হইতে হয় এই স্বল্প সময়ের মধ্যে মহারাজ এমন দুর্ল্লভ শক্তি অর্জন করিলেন কোথা হইতে? বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা দ্বারা যে শক্তি ডিগ্রীধারী যুবকদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে না, সেই চক্ষুদান মহারাজ য়ুনিভার্সিটির প্রাচীরের বাহিরে থাকিয়া কেমন করিয়া স্বচ্ছন্দে লাভ করিলেন? ইহার উত্তর সহজভাবে মিলান অসম্ভব। গীতার ‘শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে’ এই উক্তির মধ্যেই যথার্থ উত্তর নিহিত রহিয়াছে। মহারাজের বয়সের সহিত তাঁহার অমিল কার্য্যকলাপ লক্ষ্য করিলে অবাক হইয়া কেবলি পূর্ব্বজন্মের কথা ভাবিতে হয়।

 মহারাজ স্বরাষ্ট্রে ক্ষত্রিয়মণ্ডলী গঠন দ্বারা জাতীয় সংগঠনের বনিয়াদ তৈরী করিয়াছেন, বিবিধ শাসন সংস্কার দ্বারা রাষ্ট্রের শক্তি উপচিত হইয়াছে। তাঁহার কর্ম্মপ্রচেষ্টা ভারতব্যাপী, তিনি স্বীয় ক্ষমতায় Chamber of Princes-এর মেম্বর এবং উক্ত চেম্বারের Standing Committee-র মেম্বর। কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ বৈদ্যশাস্ত্রপীঠের ভিত্তিস্থাপন তাঁহার হাতে হয় এবং ঐ বিশাল সৌধের দ্বারোদ্ঘাটন কার্য্যও তিনি সম্পন্ন করেন। ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে কুমিল্লায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের উদ্বোধন কার্য্য তৎকর্ত্তৃক অনুষ্ঠিত হয়। তিনি Eastern States Agency-র Council of Rulers-এর সর্ব্ববাদী সম্মত নির্ব্বাচিত প্রেসিডেণ্ট। কলিকাতা ত্রিপুরাহিতসাধিনী সভা ভবনের ভিত্তি স্থাপন মহারাজের হস্তে সম্পন্ন হয়।

 মহারাজের সবেমাত্র এই জীবনপ্রভাত, ইহারই মধ্যে পৃথিবী ভ্রমণ দ্বারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা তাঁহার অন্তরের একান্ত কাম্য হইয়া পড়িয়াছে। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে তিনি য়ুরোপ ভ্রমণ দ্বারা সে জ্ঞান পিপাসা মিটাইয়াছেন। সাধারণ ভ্রমণকারীর ন্যায় তিনি যে সকল দর্শনীয় স্থান ও আশচর্য্যজনক বস্তু নিজে দেখিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন এমন নহে পরন্তু যাঁহাদের অঙ্গুলি সঙ্কেতে পটপরিবর্ত্তনের ন্যায় য়ুরোপের এই রূপান্তর ঘটিতেছে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ আলাপে মূলের সহিত পরিচিত হইয়া তবে ফিরিয়াছেন।

 দুর্দ্ধৰ্ষ মুসোলিনীর সহিত আবিসিনীয় সমরের অনেক পূর্ব্বে ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে মহারাজের সাক্ষাৎ হয়। মুসোলিনী তাঁহার সহিত ইংরাজিতে আলাপ করেন। ইতালীয় বিমান সম্ভার যাহাতে মহারাজের দেখিবার সুযোগ ঘটে তজ্জন্য মুসোলিনী তদীয় জেনারেল বেল্‌বোকে (Balbo) বিমান ক্রীড়া প্রদর্শনের ব্যবস্থা করিতে আদেশ দেন। ইহাতে মহারাজের পরিদর্শনের বিশেষ সুবিধা হইয়াছিল। এতদুদ্দেশ্যে মুসোলিনী তাঁহার স্বীয় বিমান মহারাজের ব্যবহারের জন্য রাখিয়া দিয়াছিলেন। রোমের শিক্ষাকেন্দ্র প্রদর্শনের ব্যবস্থাও তিনি করিয়াছিলেন। মহারাজ যখন রোম দর্শনান্তে মিলান সহরে ভ্রমণরত তখন মুসোলিনীর ভ্রাতা অল্ডার মুসোলিনী (Popolo de Italia কাগজের সম্পাদক) মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ফ্যাসিষ্ট নেতার আবক্ষ মর্ম্মর মূর্ত্তি মহারাজকে উপহার প্রদান করেন। ইহাতে মহারাজের কথা যেমন দৈনিক কাগজে বাহির হইতে লাগিল, ফোটো প্রার্থী দলও তেমনি বাড়িয়া গেল। সেই সময়ই মহারাজ ফন হিণ্ডেনবার্গের সহিত পরিচিত হন, জার্ম্মাণ প্রেসিডেণ্ট মহারাজকে তাঁহার অটোগ্রাফ সহ চিত্র উপহার দেন। অলিম্পিক ক্রীড়া দর্শনকালে পরবর্ত্তী সময়ে ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে মহারাজ হের হিটলারের সহিত অর্দ্ধঘণ্টার ঊর্দ্ধকাল আলাপের সৌভাগ্য লাভ করেন, ফুরারেরও চিত্র অটোগ্রাফ্‌সহ জার্ম্মান কন্সাল কর্ত্তৃক মহারাজের নিকট উপহার স্বরূপ প্রেরিত হয়। মহারাজের সহিত আলাপকালে ফুরার ভারতীয় খেলোয়াড়ের সাফল্য কামনা করেন।

 ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে বর্ত্তমান সমর ঘোষিত হইবার পূর্ব্বেই মহারাজ দেশে ফিরিবার পথে আমেরিকা হইতে বিলাত আসিয়াছিলেন। যুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনায় তিনি পুনঃ আমেরিকা হইয়া পৃথিবী ঘুরিয়া এই ভীষণ যুদ্ধের বিভীষিক মধ্যে দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। তাঁহার জন্য রাজ্য-শুদ্ধ কি এক আশঙ্কার কালমেঘ ঘনীভূত হইয়াছিল, কিন্তু তিনি প্রফুল্ল বদনে বিধাতার অপার কৃপায় বিপদরাশি মথিত করিয়া দেশমাতৃকার কোলে ফিরিয়া আসিয়াছেন। আমেরিকা থাকাকালে প্রেসিডেণ্ট রুজভেল্ট কর্ত্তৃক পরম সমাদরে অভ্যর্থিত হন এবং রাষ্ট্রনায়কের সহিত আলাপে প্রীতিলাভ করেন। ‘To my Friend’ উল্লেখে autograph যুক্ত স্বীয় চিত্র প্রেসিডেণ্ট রুজভেল্ট তাঁহাকে উপহার প্রদান করেন। তাঁহারই পূর্ব্বপুরুষ ত্রিলোচনের রাজসূয় যজ্ঞে আমন্ত্রিত হইয়া যুধিষ্ঠিরের দর্শন সৌভাগ্য লাভ করার কথা ইতিহাসের প্রারম্ভে বর্ণিত হইয়াছে। দ্বাপরান্তে কলিযুগে সেই পুণ্যশ্লোক নৃপতির বংশধর সাগরপারে যুক্তরাষ্ট্রের নায়কের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যুগ উপযোগী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন।

 মহারাজ হৃদয়বান্ পুরুষ। তাঁহার হৃদয়ের পরিচয় জনহিতৈষণা দ্বারা দেশ দেশান্তরে ব্যক্ত হইয়া পড়িয়াছে। কিছুকাল পূর্ব্বে ঢাকায় দাঙ্গা হাঙ্গামার ফলে তদঞ্চলের কতিপয় গ্রামে হিন্দুপ্রজা উপদ্রুত হইলে এবং অনন্যোপায় হইয়া মহারাজের রাজ্যে আসিতে চাহিলে তিনি তাহাদিগকে আসিবার অনুমতি দেন। ইহার ফলে দেখিতে দেখিতে প্রায় বার হাজার লোকে রাজধানী ভরিয়া যায়। ১৩৪৭ বাঙ্গালা সনের ২০শে চৈত্র রাত্রি দুপুর হইতে এই নিঃসহায় জনস্রোত সহরে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করে। ষ্টেশন হইতে সহর ৫।৬ মাইল দূর, দিবারাত্র ষ্টেট যানবাহন, মহারাজের হুকুমে আর্ত্ত ও পীড়িত লোকদিগকে সহরের ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রে পৌঁছাইতে থাকে।

 তখন সবেমাত্র মহারাজের মাতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন হইয়াছে। হবিষ্যান্ন-ক্ষীণ শরীরে মহারাজ ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরিয়া ইহাদের বসবাসের সর্ব্বপ্রকার সুবিধা করিতে থাকেন। অন্নসত্র খোলা হইয়া গেল—বার হাজার আর্ত্তের আহারোপযোগী অন্নশালায় যেন অন্নপূর্ণা সাক্ষাৎ আবির্ভূতা হইলেন। এই নিরন্নের মুখে অন্ন দিতে একমাসের কম সময়ের মধ্যে মহারাজের বিশ সহস্র মুদ্রা ব্যয়িত হইয়াছিল। ১৩৪৮ বাঙ্গালার জ্যৈষ্ঠ মাসেও অন্নসত্র খোলা রহিয়াছে, তবে লোক সংখ্যার অনেক হ্রাস ঘটিয়াছে, ইহাদের অনেকেই স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়াছে, যাহারা যাইতে অনিচ্ছুক মহারাজ তাহাদের জন্য নিজব্যয়ে বাসগৃহ নির্ম্মাণ করিয়া দিতেছেন এবং গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য জমি বন্দোবস্ত দিতেছেন। মহারাজের এই অভূতপূর্ব্ব জন-হিতকর ব্রতের সুযোগ পাইয়া জনসেবাপরায়ণ রাজধানীস্থ ব্যক্তিবর্গও ধন্য হইয়াছে। দৈনিক সংবাদপত্রের মুখে এ কাহিনী দেশ দেশান্তরে এতটা প্রচারিত হইয়াছে যে এ সম্বন্ধে অধিক উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।

 ১৩৪৮ বাঙ্গালার ২৫শে বৈশাখ বৃহস্পতিবার কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথের অশীতিবর্ষ পূর্ণ হওয়ায় দেশে জয়ন্তী উৎসবের সাড়া পড়িয়া যায়। ত্রিপুরা রাজ্যের সহিত কবিবরের ঘনিষ্ঠতা অর্দ্ধশতাব্দীর ঊর্দ্ধকাল চলিতেছে, এ সম্পর্কে যথা স্থানে উল্লেখ করা হইয়াছে। মহারাজ এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে সম্মানিত করিবার জন্য “রবীন্দ্র জয়ন্তী দরবার” আহ্বান করেন এবং ঐ দরবারে কবিকে “ভারত ভাস্কর” আখ্যায় ভূষিত করেন। মহারাজের রোবকারী শান্তিনিকেতনে কবির হস্তে প্রদান করিবার জন্য রাজদূত প্রেরিত হয়।

 ৩০শে বৈশাখ মঙ্গলবার উত্তরায়ণের প্রাঙ্গনে সভার অধিবেশন হয়—চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠানের মধ্যে রোবকারী পাঠান্তে কবির হস্তে উহা মহারাজের নামাঙ্কিত মোহর সহ অর্পিত হয়। কবি সাগ্রহে উহা গ্রহণ করেন এবং মহারাজকে তাঁহার সর্ব্বান্তঃকরণে আশীর্ব্বাদ জ্ঞাপন করেন। শরীর অত্যন্ত অসুস্থ বলিয়া কবির প্রত্যুত্তর পুত্র রথীন্দ্রনাথ পাঠ করেন।

 “ত্রিপুরা রাজবংশ থেকে একদা আমি যে অপ্রত্যাশিত সম্মান পেয়েছিলাম আজ তা বিশেষ করে স্মরণ করবার ও স্মরণীয় করবার দিন উপস্থিত হয়েছে। এ রকম অপ্রত্যাশিত সম্মান ইতিহাসে দুর্ল্লভ। যেদিন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য এই কথাটি আমাকে জানাবার জন্য তাঁর দূত আমার কাছে প্রেরণ করেছিলেন যে তিনি আমার তৎকালীন রচনার মধ্যেই একটি বৃহৎ ভবিষ্যতের সূচনা দেখেছেন, সেদিন এ কথাটি সম্পূর্ণ আশ্বাসের সহিত গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।

 আমার তখন বয়স অল্প, লেখার পরিমাণ কম এবং দেশের অধিকাংশ পাঠক তাকে বাল্যলীলা বলে বিদ্রূপ করতো। বীরচন্দ্র তা জানতেন এবং তাতে তিনি দুঃখ বোধ করেছিলেন। সেইজন্য তাঁর একটি প্রস্তাব ছিল এই, লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি নূতন ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার অলঙ্কৃত কবিতার সংস্করণ ছাপানো হবে। তখন তিনি ছিলেন কার্শিয়াং পাঙ্গড়ে, বায়ু পরিবর্ত্তনের জন্য। কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমি মনে ভাবলুম এই মৃত্যুতে রাজবংশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে তা হয়নি।

 কবি-বালকের প্রতি তাঁর পিতার স্নেহ ও শ্রদ্ধার ধারা মহারাজ রাধাকিশোরের মধ্যেও সম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্ন রয়ে গেল। অথচ সে সময়ে তিনি ঘোরতর বৈষয়িক দুর্য্যোগের দ্বারা দিবারাত্রি অভিভূত ছিলেন। তিনি আমাকে একদিনের জন্যও ভোলেন নি। তারপর থেকে নিরন্তর তাঁর আতিথ্য ভোগ করেছি এবং আমার প্রতি তাঁর স্নেহ কোনদিন কুণ্ঠিত হয় নি যদিচ রাজসান্নিধ্যের পরিবেশ নানা সন্দেহ বিরোধ দ্বারা কণ্টকিত। তিনি সর্ব্বদা ভয়ে ভয়ে ছিলেন পাছে আমাকে কোনো গোপন অসম্মান আঘাত করে। এমন কি তিনি আমাকে নিজে স্পষ্টই বলেছেন, আপনি আমার চারিদিকের পারিষদদের ব্যবহারের বাধা অতিক্রম করেও যেন আমার কাছে সুস্থ মনে আসতে পারেন, এই আমি কামনা করি। এ কারণে যে অল্পকাল তিনি বেঁচেছিলেন কোন বাধাকেই আমি গণ্য করিনি।

 যে অপরিণত বয়স্ক কবির খ্যাতির পথ সম্পূর্ণ সংশয় সঙ্কুল ছিল তার সঙ্গে কোনো রাজত্ব গৌরবের অধিকারীর এমন অবারিত ও অহৈতুক সখ্য সম্বন্ধের বিবরণ সাহিত্যের ইতিহাসে দুর্ল্লভ। সেই রাজবংশের এই সম্মান মূর্ত্ত পদবী দ্বারা আমার স্বল্পাবশিষ্ট আয়ুর দিগন্তকে আজ দীপ্যমান করেছে। আমার আনন্দের একটি বিশেষ কারণ ঘটেছে, বর্ত্তমান মহারাজ অত্যাচারপীড়িত বহু সংখ্যক দুর্গতিগ্রস্ত লোককে যে রকম অসামান্য বদান্যতার দ্বারা আশ্রয় দান করেছেন তার বিবরণ পড়ে আমার মন গর্ব্বে এবং আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। বুঝতে পারলুম তাঁর বংশগত রাজ-উপাধি আজ বাংলা দেশের সর্ব্বজনের মনে সার্থকতর হয়ে মুদ্রিত হোল। এর সঙ্গে বঙ্গলক্ষ্মীর সকরুণ আশীর্ব্বাদ চিরকালের জন্য তাঁর রাজকুলকে শুভ শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত করে তুলেছে। এ বংশের সকলের চেয়ে বড় গৌরব আজ পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠলো এবং এইদিনে রাজহস্ত থেকে আমি যে পদবী ও অর্ঘ্য পেলেম তা সগৌরবে গ্রহণ করি এবং আশীর্ব্বাদ করি এই মহাপুণ্যের ফল মহারাজের জীবনযাত্রার পথকে উত্তরোত্তর নবতর কল্যাণের দিকে যেন অগ্রসর করতে থাকে। আজ আমার দেহ দুর্ব্বল, আমার ক্ষীণকণ্ঠ সমস্ত দেশের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁর জয়ধ্বনিতে কবি জীবনের অন্তিম শুভ কামনা মিশ্রিত করে দিয়ে মহা নৈঃশব্দের মধ্যে শান্তি লাভ করুক।”

 মহারাজ বীর বিক্রমকিশোরের হৃদয় স্পন্দনে সমগ্র প্রাচীন ইতিহাস জীবন্ত হইয়া রহিয়াছে। অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনাস্রোত তাঁহাকে ঘিরিয়া ভারত ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে এক অব্যাহত রাজবংশের মহিমা কীর্ত্তন করিতেছে।

 রাজবংশের কুলাচরিত প্রথা অনুযায়ী উত্তরাধিকারী নির্ণয়, মহারাজ বীর বিক্রম করিয়াছিলেন ১৩৫০ ত্রিপুরাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ তারিখে। মহারাজকুমার কিরীট বিক্রমকিশোরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া যে দরবারের অনুষ্ঠান হয়, তাহাতে নানা রাজ্যের রাজন্যবর্গ ও প্রতিনিধিবর্গ যোগদান করিয়া সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে প্রকৃতিপুঞ্জের দেয় ছয়লক্ষ টাকা পরিমাণ খাজানা এবং মুসলমান প্রজাবৃন্দের বিবাহকালীন দেয় “কাজিয়ানা” মাপ করিয়া মহারাজ অভিষেক আনন্দকে স্মরণীয় করিয়া গিয়াছেন।

 যে অন্তর্দৃষ্টি লইয়া প্রজাসাধারণের দাবীর পূর্ব্বেই এই সমস্ত বিষয় সমাধান করিয়াছেন, তাহাতে বীরবিক্রমকিশোরের ভারতীয় জন-জাগরণের স্বরূপ সম্বন্ধে তখনই উপলব্ধি হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। বিশেষতঃ রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ক্রমশঃ আনয়ন কল্পে যে শাসনতন্ত্রের পরিকল্পনা ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহা পূর্ণ দায়িত্বশীল না হইলেও, প্রজাসাধারণকে রাজ্যশাসনের গুরু দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে পূর্ণ পথ প্রদর্শক হইয়াছিল।

 এই শাসনতন্ত্রের মূলকথা হইয়াছিল—ত্রিপুরেশ্বরের অধিকার ও ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সাহায্যকারী “রাজসভা” বা প্রিভি-কাউন্সিল; এবং রাজ্যের শাসন কর্ত্তৃত্ব “মন্ত্রী-পরিষদ” বা মন্ত্রীসভার প্রতি ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের নিমিত্ত সরকারী ও বেসরকারী নির্ব্বাচিত সদস্যগণ গঠিত “ব্যবস্থাপক সভা”। রাজ্যের গ্রামবাসিগণ যাহাতে গ্রাম্য স্বায়ত্ত্বশাসন পরিচালনা করিতে সক্ষম হয়—তজ্জন্য “গ্রাম্যমণ্ডলী” আইন প্রবর্ত্তিত হয়।

 এই শাসনতন্ত্র ঘোষণায় মহারাজ ১৩৪৯ ত্রিপুরাব্দের ১লা বৈশাখ বলিয়াছিলেন—“যে হেতু রাজ্যভার গ্রহণাবধি এপক্ষ শিক্ষা ও গঠনমূলক ব্যবস্থাদি প্রবর্ত্তন দ্বারা পুত্রতুল্য প্রজাবৃন্দের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন, এবং স্বাবলম্বন, সহযোগিতা রাষ্ট্রানুরাগ প্রভৃতি আদর্শ নাগরিকের-ধর্ম্মে নিয়ত তাহাদিগকে প্রবুদ্ধ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন;—

পাতা নেই

পাতা নেই

আবালবৃদ্ধ নরনারীকে এই সময়ে আশ্রয় এবং আহার প্রদান করিয়া যে আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেন—তাহা প্রজাবৎসল নৃপতিরই লভ্য। অন্তরের কোমল বৃত্তির প্রকাশ মহারাজের দৈনন্দিন ছোট ছোট কার্য্যেও অহরহ সকলে অনুভব করিয়াছেন।

 পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে ইউরোপখণ্ডে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবতারণা হয়। ইহা শেষ পর্য্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপক হইয়া পড়ে। মহারাজ বীরবিক্রম আমেরিকা অবস্থান কালেই ত্রিপুরারাজ্য যাহাতে মিত্রপক্ষে যোগদান করে—তদ্বিষয়ে নির্দ্দেশ দিয়াছিলেন। ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে যখন জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে দেশের পর দেশ জয় করিয়া বর্ম্মা দেশ অধিকার করিল এবং পূর্ব্বভারতে হানা দিল—তখন ত্রিপুরা রাজ্যের এক শঙ্কটময় সময় গিয়াছে। ভারত রণভূমিতে পরিণত হইল। ত্রিপুরা রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থিতিতে প্রত্যেক মুহূর্ত্তেই বিপর্য্যয়ের মধ্যে পতিত হইবার আশঙ্কা রাজ্যবাসীদের সন্ত্রস্ত করিয়া রাখিয়াছিল।

 তৎকালে বহুদর্শী সেনানায়কের ন্যায় প্রজাসাধারণের কর্ত্তব্য ও রাজ্যের সংহতি রক্ষা কল্পে সর্ব্বসাধারণের সহযোগিতা ও সাহায্য লাভের নিমিত্ত মহারাজ বীরবিক্রম একটি ঘোষণায় বিবৃত করেন। রাজ্যের ভিতরে ও বাহিরে রাস্তা নির্ম্মাণের জন্য উপকরণ এবং সৈন্যদের বাসস্থান নির্ম্মাণোপযোগী কাঠ, বাঁশ, বেত ইত্যাদি বনজবস্তু প্রচুর পরিমাণে রাজ্য হইতে ভারত গভর্ণমেণ্টকে সরবরাহ করা হইয়াছিল।

 আভ্যন্তরিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষণকল্পে একদিকে যেমন নানা বিধিনিষেধ জারী করা হইয়াছিল, অপরদিকে “ত্রিপুর রাজ্য-রক্ষী বাহিনী” গঠন করিয়া সীমান্তবর্ত্তী ঘাঁটীগুলি রক্ষাকল্পে বিশেষ তৎপরতার সহিত ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন।

 “১ম ত্রিপুরা বীরবিক্রম রাইফল্‌স্”, “ত্রিপুরা মহাবীর লিজিয়ন্” প্রভৃতি ত্রিপুর সৈন্যবাহিনী—ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহিত নানা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুবিতাড়নে নিযুক্ত হইয়াছিল। আরাকান যুদ্ধক্ষেত্রে ত্রিপুর বাহিনীর শৌর্য্য ও দক্ষতা ভারতীয় ও বৃটিশ সেনানায়কগণের অজস্র প্রশংসা অর্জ্জন করিয়াছিল। রাজপরিবারস্থ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ যুদ্ধক্ষেত্রে ত্রিপুরবাহিনী পরিচালনা করিয়া বহু সামরিক সম্মানে ভূষিত হইয়াছিলেন। ইহা সমস্তই মহারাজ বীরবিক্রমের ব্যক্তিগত প্রেরণার ফল। মহারাজ মধ্যে মধ্যে যুদ্ধরত সেনানী পরিদর্শন করিয়া তাহাদের স্বদেশরক্ষার গৌরব বৃদ্ধি করিতেন।

 এই সময়ে সারা ভারতময় যুদ্ধোপকরণ ও সমরসম্ভার সরবরাহে যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়া দেশের অর্থনৈতিক বিপর্য্যয় আনয়ন করিতেছিল তাহা ত্রিপুরা রাজ্যকেও আঘাত করিয়াছিল। সৈনিক বিভাগের কাজকর্ম্ম করিয়া রাজ্যের কতিপয় লোক অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অতিরিক্ত মজুরী লাভে দিন মজুরেরাও বহুগুণ বেশী উপার্জ্জন করিতেছিল। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত বস্তু ও ও আহার্য্যের দর ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিয়াছিল। ইহাতে বিশেষ করিয়া নির্দ্দিষ্ট আয়ের মধ্যে থাকিয়া দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারবর্গ দিন দিন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল। এই অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ নরনারী মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছিল। ত্রিপুরারাজ্যের পার্শ্ববর্ত্তী স্থানে চাউলের মূল্য প্রতি মণ যখন ৫০৲ হিসাবে বিক্রয় হইতেছিল তখন রাজ্যমধ্যে বহিরাগত বুভুক্ষু নরনারীর সমাবেশ দেখা দিল। মহারাজের বিশেষ আদেশে ধান-চাউল রপ্তানী নিয়ন্ত্রিত হইল। যাহাতে সকলে নির্দ্ধারিত মূল্যে ধান-চাউল বরাদ্দ অনুযায়ী পাইতে পারে—তজ্জন্য রাজ্যমধ্যে সরকারী তত্ত্বাবধানে বিতরণ কেন্দ্র খোলা হইল। যদিও দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া রাজ্যমধ্যেও পড়িয়াছিল, কিন্তু সুখের বিষয় রাজ্যবাসী প্রজাদের কাহারও প্রাণহানি হয় নাই। ধান-চাউল স্বল্পমূল্যে বিতরণ কার্য্যে সরকার বাহাদুরকে কয়েক লক্ষ টাকার উপর ঘাট্‌তি বহন করিতে হইয়াছিল। সহরে যে সমস্ত বুভুক্ষু নরনারী ও শিশু বাহির হইতে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল তাহাদের জন্যও মহারাজের ব্যক্তিগত সাহায্যে এবং জনসাধারণের চেষ্টায় একটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হইয়াছিল। দুঃস্থ আশ্রিতদের সেবা ও রোগে ঔষধ পথ্যাদি দেওয়ার ব্যবস্থাও সরকার হইতে করা হইয়াছিল। বীর বিক্রমকিশোরের করুণ হৃদয়ে দুঃখীর বেদনা যেভাবে আঘাত করিত—উপরোক্ত ব্যবস্থা হইতেই ইহা অনুভূত হয়।

 অপরদিকে ভারতে বৃটিশ শাসকবর্গের কূট আলাপ-আলোচনা দিন দিন ভারতীয় রাজনৈতিক গগনে ক্রমশঃ বিপর্য্যয় ঘনাইয়া আসিতেছিল। দেখিতে দেখিতে সর্ব্বত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এমনভাবে ছড়াইয়া পড়িল যে হিন্দু মুসলমানদের প্রীতির বন্ধন অবিশ্বাসের মূলসূত্রে পরিণত হইল। ইহারই ফলে কলিকাতার দাঙ্গা—নোয়াখালীতে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, স্থানীয় অধিবাসীদের আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া, পিতৃ পিতামহের বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া অনির্দ্দিষ্টের যাত্রায় অনেকে বাহির হইয়া পড়িল। সুখের ও গৌরবের বিষয় ত্রিপুরারাজ্যে এই সময় হইতে বর্ত্তমান সময় পর্য্যন্ত কোনও প্রকার সাম্প্রদায়িক বিষ সংক্রামিত হয় নাই। ইহার জন্য একদিকে বীরবিক্রমকিশোরের দৃঢ়তা ও অপরদিকে সর্ব্ব সম্প্রদায়ের প্রতি সমদৃষ্টি ঘোষণা, সকলের মনেই জাগরূক থাকিবে। বিশেষতঃ ত্রিপুরা রাজ্যে নোয়াখালী ও অপরাপর জিলা হইতে আগত আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যবস্থা ইত্যাদি ভারতীয় চিন্তানায়কগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।

 ইতিমধ্যে ভারতীয় গণপরিষদ ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়ণকল্পে আহূত হইল। দেশীয় রাজ্য এবং রাজন্যবর্গের প্রতিও ইহাতে যোগদানের আহ্বান আসিল। মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর প্রজাসাধারণের প্রতিনিধিত্বের সহযোগিতায় ত্রিপুরারাজ্যের পক্ষে তৎকালীন রাজস্ব-সচিবকে গণ-পরিষদে যোগদান করিবার নিমিত্ত প্রেরণ করেন। অতঃপর ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা কুয়াশাজালে জড়িত হইয়া শেষ পর্য্যন্ত ভাবতীয় ও পাকিস্থান রাষ্ট্রে ভারত বিভাগ হইল। প্রথম হইতেই ত্রিপুরারাজ্য ভারতীয় রাষ্ট্রে যোগদান করিয়াছিল। রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া মহারাজ বীরবিক্রমের ত্রিপুরারাজ্যকে ভারতীয় রাষ্ট্রে যোগদানের নির্দ্দেশ কতদূর সুদূর প্রসারী হইয়াছিল, তাহা তাঁহার তিরোধানের অনতিকাল মধ্যেই বিশেষভাবে অনুভূত হইয়াছিল।

 কিছুকাল যাবত মহারাজের স্বাস্থ্য ভাল চলিতেছিল না। ইহা সত্ত্বেও সামরিক ও রাজনৈতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্ব্বদা জড়িত থাকিতে মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর কোনও প্রকার শৈথিলা বোধ করেন নাই। মহারাজের সহিত আলোচনান্তে কোনও বিশিষ্ট রাজনৈতিক মন্তব্য করিয়াছিলেন যে আলোচিত বিষয়ে তিনি এক নূতন ধারা পাইলেন, যাহা পূর্ব্বে কখনও তাঁহার সম্মুখে কেহ উত্থাপন করেন নাই।

 মাত্র দশদিন যাবৎ জ্বর ও নিমোনিয়ায় ভুগিয়া ৩৯ বৎসর বয়সে মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর ১৩৫৭ ত্রিপুরাব্দের ২রা জ্যৈষ্ঠ তারিখে রাত্রি পৌনে নয়টায় রাজধানী আগরতলায় নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।

 বয়ঃকনিষ্ঠ হইলেও তাঁহার অপরিসীম জ্ঞানবত্তা সম্বন্ধে যাহারা মহারাজ বীরমিক্রমকিশোরের নৈকট্য লাভের সুযোগ পাইয়াছিলেন, তাহারাই মুগ্ধ হইয়াছেন। ইহা অর্জ্জিত জ্ঞান বলিলে ভুল করা হইবে বলিয়া আমাদের মনে হয়। ইহা ঐশ্বরিক কৃপাই নির্দ্দেশ করে। এই জ্ঞানের পরিস্ফুরণ শিল্প ও সঙ্গীত কলায় নব নব ভাবে বিকশিত হইয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছে। বীরবিক্রমকিশোর রচিত “হোলী” তদীয় রাগরাগিণী ও ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে অসীম ব্যুৎপত্তি ও জ্ঞানের পরিচায়ক।

 রাজ্যের ও ভারতের রাজনৈতিক এক অস্বস্তির মধ্যে বিশেষতঃ যুগধর্ম্ম প্রভাবজাত আশা আকাঙ্ক্ষার অভ্যুত্থানের মধ্যে মহারাজ বীরবিক্রমকিশোরের তিরোধান ত্রিপুরারাজ্যকে অশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছে।