গৌড়রাজমালা/প্রথম বিগ্রহপাল

উইকিসংকলন থেকে

 দেবপালের মৃত্যুর পর, বিগ্রহপাল গৌড়-রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। হরগৌরীর [বাদল] স্তম্ভে বিগ্রহপাল শূরপাল নামে উল্লিখিত হইয়াছেন। নারায়ণপালের [ভাগলপুরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে বিগ্রহপাল “অজাতশত্রু”, “শক্রগণের গুরুতর বিষাদ”, এবং “সুহৃজ্জনের আজীবনস্থায়ী সম্পদ্”-বিধানকারী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। ভাগলপুরের তাম্রশাসনে যে প্রশস্তিকার ধর্ম্মপাল কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ-বিজয় এবং দেবপালের আদেশে জয়পাল কর্ত্তৃক কামরূপ ও উৎকল-বিজয় বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, বিগ্রহপালের সম্বন্ধে তেমন কিছু বলিবার থাকিলে তিনি যে তাহা না বলিয়া ছাড়িতেন, এরূপ বোধ হয় না। বিগ্রহপাল, ধর্ম্মপাল এবং দেবপালের প্রতিভা এবং উচ্চাভিলাষ উভয়েই বঞ্চিত ছিলেন। তিনি হৈহয় বা কলচুরি-রাজকুমারী লজ্জাদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। তৎকালে কলচুরি-রাজ কোক্কল্ল এবং তাঁহার পুত্রগণ এতই পরাক্রান্ত হইয়া উঠিয়ছিলেন যে প্রতিবেশী নৃপতিগণ তাঁহাদের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারিলে, আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করিতেন। রাষ্ট্রকূট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ কোক্কল্লের দুহিতার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, এ কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগত্তুঙ্গ কোক্কল্লের দুই পৌত্রীর, এবং জগত্তুঙ্গের পুত্র রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্র কোক্কল্লের প্রপৌত্রীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।[১] বিগ্রহপালের মহিষী লজ্জাদেবী সম্ভবতঃ কোক্কল্লের পুত্রী বা পৌত্রী ছিলেন। গোরখপুর জেলার অন্তর্গত কন্থল নামক স্থানে প্রাপ্ত কলুচুরি-রাজ সোঢ়দেবের ১১৩৬ বিক্রম-সম্বতের (১০৭৯ খৃষ্টাব্দের) একখানি তাম্রশাসনে মিথিলা বা ত্রিহুতের উত্তরদিকে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বতন্ত্র কলচুরি বা হৈহয়-রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। এই তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে, সোঢ়দেবের ঊর্দ্ধতন ষষ্ঠ পুরুষ (অতিবৃদ্ধ-প্রপিতামহ) গুণাম্বোধিদেব বা গুণসাগর সংগ্রামে গৌড়লক্ষ্মী অপহরণ করিয়াছিলেন (“আহৃতা গোঁড়লক্ষ্মী”)।[২] গৌড়াধিপ বিগ্রহপালের সহিতই সম্ভবত গুণাম্বোধিদেবের যুদ্ধ হইয়াছিল। গৌড়েশ্বরী লজ্জাদেবী এই গুণাম্বোধিদেবের কন্যাও হইতে পারেন।

 বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর, মহারাণী লজ্জার গর্ভজাত নারায়ণপাল পিতৃ-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র, হরগৌরীর গরুড়স্তম্ভ-প্রতিষ্ঠাতা গুরবমিশ্র, নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন। এই স্তম্ভলিপির একটি শ্লোকে (১৯) নারায়ণপল “বিজিগীষু” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। নারায়ণপালের রাজত্বের সপ্তদশ বৎসরে ভাগলপুরের তাম্রশাসন সম্পাদিত হইয়াছিল। এই শাসনের আটটি শ্লোকে নারায়ণপালের ন্যায়নিষ্ঠা, দানশীলতা, এবং সাধু-চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করা হইয়াছে; কিন্তু তিনি বিজিগীষু হইয়া, কোন্ দেশ আক্রমণ বা জয় করিয়াছিলেন, তাহার কোন উল্লেখ নাই।

 নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপালও শান্তিপ্রিয় ছিলেন। মহীপালের দীনাজপুর জেলার অন্তর্গত বাণনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে,—রাজ্যপাল “জলধিমূল-গভীরগর্ভ” জলাশয় এবং “কুলপর্ব্বততুল্য কক্ষবিশিষ্ট দেবালয়” নির্ম্মাণ করিয়া কীর্ত্তিলাভ করিয়াছিলেন। রাজ্যপাল রাষ্ট্ৰকূটতুঙ্গের কন্যা ভাগ্যদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই “তুঙ্গ” সম্ভবত দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগত্তুঙ্গ। রাজ্যপাল এবং ভাগ্যদেবীর পুত্র, দ্বিতীয় গোপাল, পিতার পরলোক গমনের পর সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, “চিরতরে” “অবনীর একমাত্র ভর্ত্তা” ছিলেন বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।

 বিগ্রহপাল এবং তাঁহার পুত্র, পৌত্র, এবং প্রপৌত্র যখন যথাক্রমে গৌড়মণ্ডলে শাসনদণ্ড পরিচালন করিতেছিলেন, তখন জেজাভুক্তির (বর্তমান বুন্দেলখণ্ডের) চন্দেল্ল-রাজগণ পরাক্রমে গৌড়েশ্বর এবং কান্যকুব্জেশ্বর, উত্তরাপথের এই উভয় দিক্‌পালকে, অতিক্রম করতে সমর্থ হইয়াছিলেন। প্রতীহার-রাজ মহেন্দ্রপালের পুত্র মহীপাল বা ক্ষিতিপালকে (?) এবং ক্ষিতিপালের উত্তরাধিকারী দেবপালকে, আত্মরক্ষার জন্য, চন্দেল্ল-রাজগণের সহিত মৈত্রী স্থাপন করিতে হইয়াছিল। চন্দেল্ল-রাজ যশোবর্ম্মার ১০১১ সম্বতে (৯৫৪ খৃষ্টাব্দে) উৎকীর্ণ খাজুরাহের একখানি শিলালিপি হইতে জানা যায়,—যশোবর্ম্মার পিতা হর্ষদেবের সহায়তায়, সিংহাসনচ্যুত ক্ষিতিপাল, কান্যকুব্জ-সিংহাসন-পুনরুদ্ধারে সমর্থ হইয়াছিলেন।[৩] এই ক্ষিতিপাল বা মহীপাল রাষ্ট্ৰকূট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্র কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ হইতে তাড়িত হইয়াছিলেন।[৪] মহীপালের উত্তরাধিকারী কান্যকুব্জপতি দেবপাল চন্দেল্ল-রাজ যশোবর্ম্মাকে বৈকুণ্ঠ-মূর্ত্তি উপহার প্রদান করিয়াছিলেন। যদি এই চন্দেল্ল-রাজের (যশোবর্ম্মার) প্রশস্তিকারের বাক্যে আস্থা-স্থাপন করিতে হয়, তবে স্বীকার করিতে হইবে, তিনি গৌড়পতিকেও ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়ছিলেন। কারণ, এই শিলালিপির একটি (২৩) শ্লোকে যশোবর্ম্মা “গৌড়ক্রীড়ালতাসি”, [ক্রীড়ার লতার ন্যায় গৌড়গণকে ছেদনক্ষম অসি] এবং “শিথিলিত-মিথিল” [মৈথিলগণের বলক্ষয়কারী] বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন।

 কালের কঠোরশাসনে কিছুরই স্থিতিশীল হইবার সাধ্য নাই। হয় ঊর্দ্ধগতি উন্নতি, আর না হয় নিশ্চলভাবে থাকিতে গেলে, কালস্রোতের খরবেগে অধোগতি। দেবপালের মৃত্যুর পর, অর্দ্ধশতাব্দী কাল গৌড়রাজ্য উন্নতিহীন নিশ্চল অবস্থায় ছিল। কিন্তু তখন হইতেই, ভিতরে ভিতরে, অধঃপাতের সূত্রপাত হইতেছিল। দ্বিতীয় গোপালের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় বিগ্রহপালের ভাগ্যে অখণ্ড গৌড়-রাজ্য সম্ভোগ ঘটিয়া উঠিয়াছিল না। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মহীপালের বাণনগরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে, “(দ্বিতীয় বিগ্রহপাল) হইতে শ্রীমহীপালদেব নামক অবনীপাল জন্মগ্রহণ করিয়ছিলেন। তিনি বাহুবলে যুদ্ধে সকল বিপক্ষ নিপাতিত করিয়া, অনধিকারী কর্ত্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করিয়া, ভূপালগণের মস্তকে চরণপদ্ম স্থাপন করিযাছিলেন।” এখানে স্পষ্টই বলা হইয়াছে—গৌড়রাজ্যের কতকাংশ দ্বিতীয় বিগ্রহপালের হস্তচ্যুত হইয়াছিল। নিরর্থক হইলে, এরূপ অগৌরবকর কথা কদাচ তাঁহার পুত্রের তাম্রশাসনে স্থানলাভ করিত না। এখন জিজ্ঞাস্য, কাহার দ্বারা দ্বিতীয় বিগ্রহপাল রাজ্যভ্রষ্ট হইয়াছিলেন?

  1. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App. II, p. 3.
  2. Epigraphia Indica, Vol, VII, p. 85.
  3. বৃটীশ মিউজিয়মের পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি “অষ্টসাহস্রিক-প্রজ্ঞা-পারমিতা” পুঁথির অন্তে লিখিত আছে,—“পরমেশ্বর-পরমভট্টারক-পরমসৌগত-মহারাজাধিরাজ-শ্রীমদ্ গোপালদেব-প্রবর্দ্ধমান-কল্যাণ-বিজয়রাজ্যেত্যাদি সম্বৎ ১৫ অস্মিনে দিনে ৪ শ্রীমদ্‌বিক্রমশীলদেববিহারে লিখিতেয়ং ভগবতী।” এই গোপালদেব দ্বিতীয় গোপাল বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে।—Journal of the Royal Asiatic Society, 1910, pp. 150-151.
  4. Epigraphia Indica, Vol. I, pp. 122-135.