ভারতবর্ষে/ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ

উইকিসংকলন থেকে

(৪)

ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ।

 ফরাসী লেখক আন্দ্রে শেভ্রিয়োঁ ভারতের মায়াবাদ সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা সর্ব্বাংশে আমাদের মতের সহিত ঐক্য না হউক্‌, তাহার মূলে যে অনেকটা সত্য আছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বৈদিক যুগ হইতে মায়াবাদের সূত্রপাত হইয়া কি করিয়া ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করিয়াছে এবং তাহার বিষময় ফল আমাদের সমাজের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে তাহা তিনি বিশদরূপে দেখাইয়া দিয়াছেন। একজন বৈদেশিক কিছুকালের জন্য এদেশে ভ্রমণ করিতে আসিয়া আমাদের শাস্ত্রের মর্ম্ম যে যথার্থরূপে গ্রহণ করিতে পারিবেন ইহা প্রত্যাশা করা যায় না। তবু কতকটা যে তিনি পারিয়াছেন, ইহাই আশ্চর্য্য। তিনি দুই একটা কঠোর কথা বলিয়াছেন; তাহা আমাদের শোনা ভাল। তাহাতে উপকার ভিন্ন অপকার নাই। অনেক সময় আমাদের নিজের দোষ গুণ নিজে বুঝিতে পারি না; তাহা বাহিরের লোকের চোখে পড়ে। যাহা হউক, তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহাতে একটু নূতনত্ব আছে। তিনি বলেন, “এই অদ্বৈতবাদ যাহা ভারতবর্ষে দুই হাজার বৎসর হইতে চলিয়া আসিতেছে, ইহা কোন ব্যক্তিবিশেষের বা সম্প্রদায়বিশেষের মত নহে। সমস্ত হিন্দুজাতি সাধারণতঃ জগৎকে যে ভাবে দর্শন করে, তাহাই দার্শনিক ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে মাত্র। ইহা ভাল করিয়া যদি বুঝিতে চাও আর কোন জাতির আভ্যন্তরিক ভাব আলোচনা করিয়া দেখ; ব্রাহ্মণদিগের পুরাতন দার্শনিক কবিতা সকল পাশাপাশি রাখিয়া, বাইব্‌ল্‌ গ্রন্থখানি একবার পাঠ করিয়া দেখ। তাহাতে কি দেখিতে পাও? আর কিছুই নহে, কতকগুলি গীতিকবিতা মাত্র; রোষ, দ্বেষ, নিরাশা, উৎসাহ, উচ্ছ্বাস, মনের প্রচণ্ড ভাবসমূহ, আত্মার সমস্ত কম্পন ও আন্দোলন, রূঢ় উপমার দ্বারা ও জ্বলন্ত কল্পনা-সহকারে ব্যক্ত হইয়াছে মাত্র; তাহার লিখনধারাও বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক এবং ভাষাও অতি সরল ও অস্ফুট; সে ভাষায় দার্শনিক চিন্তার তরঙ্গলহরী অনুসরণ করা সুকঠিন—তাহাতে কেবল অস্ফুট কণ্ঠে মানব আত্মার আবেগ প্রকাশ করা যায় মাত্র। মনের আবেগ স্থায়ী ও প্রচণ্ড হইলে তাহার ফল কি হয়?—না, মানুষ আপনার উপর ফিরিয়া আইসে। যখন সে যন্ত্রণা ভোগ করে, যখন সে কাহারো প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করে, তখন সে আপনাকে অতিক্রম করিতে পারে না। যে বহির্জগতের সহিত তাহার সংঘর্ষণ উপস্থিত হয়, সে বহির্জগৎকে সে পৃথক্‌ ভাবে দর্শন করে। যে আত্মা আবেগপূর্ণ তাহাতে আমিত্ব দৃঢ়রূপে সংলগ্ন থাকে ও পৃথক্‌ভাবে অবস্থান করে; এই অবস্থাতে সে যখন জগতের মূল তলাইয়া দেখিবার চেষ্টা করে, তখন সে সেই মূলকে স্বতন্ত্র ও সর্ব্বশক্তিমান আত্মা বলিয়াই কল্পনা করে।

 “কিন্তু ব্রাহ্মণদিগের মনের গতি ভিন্নরূপ হওয়ায় তাহাতে ভিন্নরূপ ফল উৎপন্ন হইয়াছে। বেদে কি দেখিতে পাওয়া যায়? তাহাতে কেবল প্রকৃতিবর্ণনামূলক কবিতা,—অরুণ, বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, পৃথিবী ইহাদেরই স্তুতিগান। উহা বহির্মুখী, অন্তর্মুখী নহে। উহাতে ব্যক্তিগত হৃদয়ের ভাব কিছুই নাই। উহাতে আত্মা স্বতন্ত্র বলিয়া উপলব্ধি হয় না, কেবল প্রকৃতির প্রতিবিম্ব—পরিবর্ত্তনশীল ছায়ামাত্র বলিয়া মনে হয়। প্রকৃতিতে যেমন-যেমন পরিবর্ত্তন উপস্থিত হইতেছে, আত্মাও উপস্থিতমত তাহারই ক্ষণস্থায়ী আকার ধারণ করিতেছে। কখনও মেঘরূপে নীল আকাশে ভাসমান, কখনও সূর্য্যরূপে দিগন্তে সমুদিত। এই আত্মাতে কোন আবেগ স্থায়ীরূপে থাকিতে চায় না, অন্তরে ঘনীভূত হইতে পারে না, পরিপুষ্ট হইতে পারে না; তাহার উপর দিয়া দ্রুতভাবে চলিয়া যায় মাত্র। আত্মা আপনাকে বাহিরে প্রক্ষিপ্ত করে; আপনার চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী ভাবসমূহ বহির্জগতে আরোপ করে। যদি আনন্দ হইল, তবে সে আনন্দ অগ্নির—যিনি দ্রাক্ষালতার মধ্যে দীপ্তি পাইতেছেন; যদি লজ্জা ভয়ের উদ্রেক হইল, তবে সে লজ্জা ভয় তরুণ উষার; লজ্জারক্তিম-কপোল বালিকার ন্যায় উষা যেন মেঘের অন্তরালে লুকাইতেছে। অর্থাৎ একটি অখণ্ড পদার্থের মধ্যে কেন্দ্রীভূত না হইয়া, যে ‘আমি’ ইচ্ছা করিতেছে, কাজ করিতেছে, সুখ দুঃখ ভোগ করিতেছে সেই আমির মধ্যে বদ্ধ না থাকিয়া বৈদিক কবি আপনাকে বিশ্বময় ছড়াইয়াছেন। তিনি সমস্ত পদার্থে পরিব্যাপ্ত; প্রকৃতির আকার, প্রকৃতির শব্দ, প্রকৃতির বর্ণ এই সমস্তের স্থান তাঁহার আত্মা অধিকার করিতেছে এবং প্রকৃতিও তাঁহার চিন্তায়, তাঁহার কল্পনায়, সজীব হইয়া উঠিতেছে।

 “বৈদিক কবি প্রকৃতির জীবন্ত ও দেবোপম শক্তিগুলির পূজা করেন বটে, কিন্তু তাঁহার এই অদ্বৈতধর্ম্ম একটু বিশেষ ধরণের। ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, সূর্য্য এই সকল দেবাত্মা বটে, কিন্তু ইহাদের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য তেমন সুস্পষ্ট নহে—ইহাদের পরস্পরের মধ্যে আকার-বিনিময় ও পরিবর্ত্তন চলিতেছে। এই উষাই সুর্য্য, এই সূর্য্যই অগ্নি, এই অগ্নিই বিদ্যুৎ, এই বিদ্যুৎই ঝটিকা এবং এই ঝটিকাই বৃষ্টি; সকলই পরস্পরের মধ্যে যুক্ত, মিশ্রিত এবং ওতপ্রোত। ইহার মধ্যে কিছুই স্থায়ী নহে। মনুষ্যের মধ্যেও স্থায়ী ব্যক্তিত্বের ভাব নাই—বাহ্যজগতেও কেবলি পরিবর্ত্তন। এই ভাবটি বেদেতে যাহা বীজরূপে অবস্থিত, তাহা ব্রাহ্মণদিগের পুরাতন দার্শনিক কাব্যসমূহে বৰ্দ্ধিত ও পরিপুষ্ট হইয়া ক্রমশঃ বৃক্ষরূপে পরিণত হইয়াছে। এই সকল গ্রন্থ পাঠ করিলে দেখা যায়, যে আমিত্বের ভাব যুরোপীয়দিগের চিন্তা ও ধারণার মধ্যে বদ্ধমুল, সেই আমিত্ব উহাতে নাই। মনের এই অবস্থা ভাল করিয়া বুঝিতে হইলে, আমাদের জীবনের কোন বিশেষ মুহূর্ত্তকে স্মরণ করিয়া দেখিতে হয়। কখন কখন আমাদের জীবনে একপ্রকার স্বপ্নবৎ অবস্থা হয়, তখন যেন আমাদের আমিত্বটা শিথিল হইয়া আসে, তখন আপনার নাম উচ্চারণ করিলেও যেন কোন ব্যক্তির ভাব মনে আইসে না, যেন অর্থহীন শব্দমাত্র বলিয়া উপলব্ধি হয়; তখন কষ্টের সহিত আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমি কে আছি?’ এই ‘আমি’র অর্থ কি? এই অদ্ভুত অনুভব যাহা আমাদের মধ্যে ক্ষণিক তাহা হিন্দুদিগের অন্তরে স্থায়ীভাবে অবস্থিত। তাহারা আত্মাকে এইভাবে দেখে, যেন উহা একটি ক্ষেত্র—যাহার উপর দিয়া বিবিধ স্বপ্ন ক্রমাগত গতিবিধি করিতেছে; অন্তরের মধ্যে এমন কিছুই দেখিতে পায় না যাহা স্থায়ী। ‘চলৎ চিত্তং চলৎ বিত্তং চলৎ জীবনযৌবনং।’ এই বিশ্বের অনিত্যবাদ হিন্দুদিগের মধ্যে শাস্ত্রাকারে পরিণত হইয়াছে। আমাদের দেহ অন্ন হইতে অর্থাৎ পৃথিবী হইতে উৎপন্ন; বহির্জগত হইতে পঞ্চভূত আহরণ করিয়া আনিতেছে, আবার উহা ত্যাগ করিতেছে, আবার নূতন উপকরণ গ্রহণ করিতেছে; এই প্রকারে দেহ বর্দ্ধিত হইয়া জীবিত রহিয়াছে; আমাদের জীবন কতকগুলি পরিবর্ত্তন ভিন্ন আর কিছুই নহে। ক্ষিতি, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, পশুপক্ষী, বৃক্ষ, উদ্ভিজ্জ, চিন্তা, মন, চতুর্ব্বেদ সকলই এই বিশ্বব্যাপী চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী আবর্ত্তের অন্তর্ভূত। সূর্য্য সমুদ্র জীবজন্তু উদ্ভিজ্জ হইতে যে বাষ্পরাশি নিঃশ্বসিত হইতেছে এবং যাহা সূর্য্য, জীবজন্তু ও উদ্ভিজ্জ-দেহের অংশীভূত হইয়াছিল, সেই বাষ্পরাশি উত্থিত হইয়া সম্মিলিত হইতেছে, দীপ্তি পাইতেছে, আকাশময় ধাবিত হইতেছে, শীতল হইয়া পুনর্ব্বার ধরাতলে পতিত হইতেছে, আবার অবস্থাবিশেষে, সূর্য্য, সমুদ্র, জীবজন্তু, বৃক্ষলতার আকার ধারণ করিতেছে। এই প্রকারে যাহা আমরা স্বতন্ত্র পদার্থ বলিয়া বিশ্বাস করি, তাহা অনবরত পরস্পরের মধ্যে মিশ্রিত হইতেছে, এবং পরস্পর হইতে বিযুক্ত হইতেছে। যজ্ঞের হোতা যিনি, তিনি বায়ু হইয়া ধূম হইয়া যাইতেছেন। ধূম হইয়া গিয়া বাষ্প হইয়া যাইতেছেন; বাষ্প হইয়া গিয়া মেঘ হইয়া যাইতেছেন, এবং মেঘ হইয়া অবশেষে বৃষ্টিরূপে পতিত হইতেছেন, পরে আবার প্রাণরূপে শস্যাকারে, উদ্ভিজ্জাকারে, বৃক্ষাকারে, সর্ষপাকারে পরিণত হইতেছেন।”

 “উপরে যেরূপ বর্ণিত হইল, তাহার সহিত অদ্বৈতবাদের অতি অল্পই প্রভেদ; এবং দুইটি পথ দিয়া এই অদ্বৈতবাদে উপনীত হওয়া যায়। যেহেতু, সর্ব্বপ্রকার আকৃতি একবার যাইতেছে আবার আসিতেছে, সুতরাং উহারা মায়াময়; উহাদের গুণ, উৎপত্তির পদ্ধতি, উহাদিগের হইতে প্রত্যাহরণ করিয়া লও, তাহা হইলে অবশিষ্ট কি থাকে? কিছুই থাকে না, বৌদ্ধেরা বলে নাস্তি অবশিষ্ট থাকে; জগতের কোন অস্তিত্ব নাই—নাস্তিত্ব ভিন্ন আর কিছুই নাই। ব্রাহ্মণেরা বলেন, ‘যাহা আছে তাহাই আছে—তৎসৎ— তাহা ভিন্ন আর কিছুই নাই। সেই তৎসৎ সর্ব্বগুণ-বিরহিত। যাহা “নেতি নেতি,” যাহা কারণও নহে, কার্য্যও নহে, এক কথায় তাহাই ব্রহ্ম; এই ব্রহ্ম ক্লীবলিঙ্গ শব্দবাচক, অনির্দ্দেশ্য ও বিকারশূন্য। ইনি চিন্তা করেন না, ইচ্ছা করেন না, দর্শন করেন না, জানেন না, ইনি শুদ্ধ ও নির্গুণস্বরূপ। বিশুদ্ধ চিন্তার দ্বারা এই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, এই ক্লীবলিঙ্গ ব্রহ্মের উপরিভাগে পুংলিঙ্গ ব্রহ্ম অবস্থিত। এই ব্রহ্ম জীবন্ত, স্পৃশ্য ও সবর্ণ। ইহার অর্থ এইঃ—এই চঞ্চল ক্ষণস্থায়ী আবর্ত্তের অন্তস্তলে যেরূপ একমাত্র স্থায়ী পদার্থ প্রচ্ছন্ন আছে, সেইরূপ এই আবর্ত্ত সংগঠন ও সংরক্ষণের জন্যও একটি শক্তি থাকা চাই। যেহেতু জগতে কেবলি গতি, সুতরাং এমন একটি শক্তি থাকা চাই যে এই গতিকে নিয়মিত করিতে পারে। যেহেতু, এই জগৎ প্রস্তরের ন্যায় অচল নহে, পরন্তু বৃক্ষের ন্যায় প্রাণ-বিশিষ্ট, সুতরাং ইহা সংরক্ষণ ও পরিপোষণের জন্য একটি আত্মার আবশ্যক। এই আত্মাই ব্রহ্ম, ইনি বিশ্বের বীজস্বরূপ, ইনি ‘জীবন্ত অশরীরী আত্মা’। ইনি জীবন্ত, সুতরাং সগুণ, ইনি নির্গুণ ব্রহ্মের প্রথম-আবির্ভাব—প্রথম বিকাশমাত্র। নির্গুণ ব্রহ্ম ও সগুণ ব্রহ্ম এক নহে। ব্রহ্মা ব্রহ্ম বটে, কিন্তু মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন, কালের অধীন। ‘ব্রহ্মের দুই রূপ; এক, যিনি কালকে জানেন; আর এক, যিনি কালকে জানেন না। যিনি কালকে জানেন তাঁহার অংশ আছে। এক মহান্‌ জীবন্ত আত্মার অভ্যন্তরে কালই সকল জীবকে বৰ্দ্ধিত করিতেছে ও বিনষ্ট করিতেছে, কিন্তু যিনি জানেন, স্বয়ং কাল কাহার মধ্যে বিলীন হইয়া যায়, তিনিই বেদজ্ঞ।’

 “কল্পনা করা যাউক, এক পূর্ণ সত্তা, বিশুদ্ধ ও নির্গুণ সকলের আদিতে ও সকলের মূলে বর্ত্তমান; ‘তিনি সকল আকার ও সকল বীজের আধার।’ বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করিয়া, তিনি মায়ার অধীন হইয়াছেন; ‘নিজ দেহের উপকরণ হইতে উর্ণবায় যেরূপ তন্তু আহরণ করিয়া আপনাকে আচ্ছাদন করে, সেইরূপ তিনি নিজস্বরূপনিঃসৃত গুণের দ্বারা আপনি আচ্ছন্ন হইয়া আছেন’; তাঁহার প্রথম নিসর্গ সগুণ জীবন্ত ব্রহ্ম, সেই সূক্ষ্ম সার্ব্বভৌমিক আত্মা যিনি জগতের মধ্যে থাকিয়া, জগতের বিচিত্রতা সম্পাদন করিতেছেন, সেই আত্মা পুরুষ ও নহে, স্ত্রীও নহে এবং ক্লীবও নহে।’ সেই আত্মা যিনি কোটি কোটি আকার ধারণ করিতেছেন, যাঁহা হইতে সকল পদার্থ নিঃসৃত হইয়া আবার তাঁহাতেই গমন করে, যিনি নিজে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় অস্থায়ী, যিনি কোটি কোটি যুগের পর—যাহা তাঁহার এক দিন—‘অচ্ছায়, অদেহ, অবর্ণ’ নির্গুণ পরব্রহ্মে পুনর্ব্বার লয় প্রাপ্ত হন। এই জগৎ এক প্রকাণ্ড বৃক্ষের ন্যায় শাখাপল্লব বিস্তার করিয়া আছে; ইহার মূলে যে বীজ ছিল, তাহাই সমস্ত বৃক্ষে সঞ্চালিত হইয়া, তমসাবৃত মূল হইতে সুকোমল পুষ্প পর্য্যন্ত সর্ব্বাংশে প্রাণ সঞ্চার করিতেছে। বৃক্ষের ত্বক্‌, পুষ্প, পল্লব, কোষাণু, সমস্ত পরিবর্ত্তিত হইতেছে, মরিয়া যাইতেছে, আবার নূতন হইয়া জন্মিতেছে। যে মূল-শক্তি বৃক্ষকে উৎপাদন করিয়াছিল, যাহা বৃক্ষবিশেষের জন্মমৃত্যুর মধ্যে সর্ব্বদাই বর্ত্তমান, সেই শক্তিই ক্ষণস্থায়ী ভৌতিক উপকরণ-সকলকে বিশেষ বিশেষ আকার ও শৃঙ্খলা প্রদান করিতেছে। জগতের প্রাণ, জীবন্ত ব্রহ্মরূপ যে এই শক্তি, ইহা কোথা হইতে নিঃসৃত হইতেছে?—ভূমি হইতে। ভূমিই আদিম ব্রহ্মের প্রতিরূপ। তাহা হইতে সমস্ত উৎপন্ন হইতেছে, তাহাতেই সমস্ত প্রতিগমন করিতেছে; যুগযুগান্তের পর যখন এই শক্তি—যাহা বৃক্ষকে পোষণ করিতেছিল—ক্ষয় হইবে, তখনই পরিবর্ত্তনের শেষ হইবে, বৃদ্ধির অবসান হইবে, বৃক্ষ পৃথিবীতে প্রতিগমন করিবে এবং সমস্তই নিশ্চেষ্টতার মধ্যে মগ্ন হইবে। ‘আপাততঃ, তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি শিশু, তুমি যুবতী, তুমি যষ্টি ধারী বৃদ্ধ, তুমি নীল ভ্রমর, তুমি হরিৎপক্ষ ও লোহিতনেত্র শুকপক্ষী, তুমি বজ্র, তুমি ষড়ঋতু, তুমি সমুদ্র। তুমি অনাদি, কেন না, তুমি অনন্ত, তোমা হইত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হইয়াছে। কিন্তু যেমন এই প্রবহমান নদীসকল সমুদ্রে গিয়া বিলীন হইয়া যায়, তাহাদের নাম ও আকার বিলুপ্ত হইয়া যায়, সেইরূপ, সূর্য্য, চন্দ্র, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, মক্ষিকা, ভ্রমর, পক্ষী, দেবগণ, বিষ্ণু, শিব এবং স্বয়ং কাল—যাহাতে দ্বিতীয় ব্রহ্ম বাস করেন—এই সমস্ত সেই অচিন্ত্য পুরুষে বিলীন হইয়া যাইবে, তাহাদের নাম ও আকার কিছুই থাকিবে না’। এখনও দৃশ্যমান জগতে যাহা দেখা যায় তাহা কিছুই বাস্তব নহে, তাহা আবিভাবমাত্র। ব্রহ্ম কাল-দর্পণে, মায়া-দর্পণে আপনাকে বহুধা ও বিচিত্র ভাবে দেখিতেছেন; কিন্তু বস্তুতঃ, যাহা আছে তাহাই আছে, তৎসৎ ভিন্ন আর কিছুই নাই।

 “এই অদ্বৈতবাদ, কল্পনার খেলা মাত্র নহে, সম্প্রদায়-বিশেষের মত মাত্র নহে, পরন্তু ইহা একটি গভীর বিশ্বাস যাহা ব্যবহারে পরিণত হইয়াছে, যাহা বিজন চিন্তার ও একাগ্র ধ্যানের সুপরিণত ফল। একমাত্র আপনাতে বদ্ধ হইয়া, স্বপ্নমধ্যে মগ্ন থাকিয়া, ব্রাহ্মণ বাস্তব ও স্বপ্নের মধ্যে আর প্রভেদ দেখিতে পান না, জগৎকে বাষ্পবৎ মনে করেন। জগতের সহিত তাঁহার যে বন্ধন ছিল, সে বন্ধন আর অনুভব করেন না। যাহাকে তিনি অবাস্তব বলিয়া জানিতেছেন তাহাকে কি করিয়া ভালবাসিবেন? যাহা আমাদের হাতের মধ্য দিয়া গলিয়া যাইতেছে, তাহাকে কেমন করিয়া ধরিয়া রাখিবেন?

 ‘হে মুনিপুঙ্গব! এই জঘন্য ক্ষণভঙ্গুর, রক্ত-মাংস-অশ্রু-মূত্র-পুরীষময় দেহ ধারণ করিয়া কিরূপে সুখের আশা করিব? লোভ দ্বেষ, মোহ মাৎসর্য্য, অসূয়া, বিচ্ছেদ, ভয়, দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, জরামৃত্যু, রোগশোকদ্বারা যে দেহ আক্রান্ত সে দেহ লইয়া কিরূপে সুখের আশা করিব? আমরা দেখিতেছি সকলই নশ্বর। যাহারা আর নাই তাহাদের দিকে ফিরিয়া দেখ, যাহারা এখনও হয় নাই তাহদের দিকে একবার চাহিয়া দেখ। শস্যের ন্যায় মনুষ্য পরিপক্ক হইতেছে, শস্যের ন্যায় ভূলুণ্ঠিত হইতেছে, আবার মৃত্তিকা ভেদ করিয়া উত্থান করিতেছে’......হৃদয় হইতে বাসনা নির্ম্মূল করিয়া বনে গমন করিয়া বৃহদ্রথ এইরূপ বিশ্বাস করিয়াছিলেন। উৰ্দ্ধবাহু হইয়া, সূর্য্যের দিকে নেত্র স্থির রাখিয়া তিনি সহস্ৰ বৎসর বিজন অরণ্যে শান্ত সমাহিত হইয়া বাস করিয়াছিলেন। কারণ, শান্তচিত্ততা, নিশ্চেষ্টতাই সকল হিন্দুশাস্ত্রের ব্যবহারিক সিদ্ধান্ত। সকলই মায়াময় এই সিদ্ধান্তে যদি একবার উপনীত হওয়া যায়, তবে সেই মায়াজাল হইতে আপনাকে মুক্ত করিবার চেষ্টাও স্বাভাবিক হইয় পড়ে। যদি এই মায়াময় জগতের ক্ষণস্থায়ী বাসনা, অনুভব, ইচ্ছা প্রভৃতিকে নিৰ্মূল করা যায় তবেই মুক্তিলাভ হইতে পারে, নচেৎ মুক্তিলাভের আশা নাই। এইরূপ কল্পনা-জড়িত চিন্তাপ্রভাবে হিন্দুর অন্তর একেবারে শূন্য হইয়া পড়িল; কাজ করিবার আর কোন উদ্দেশ্য রহিল না—যখন নিজেরই অস্তিত্ব নাই, তখন কাজ করিয়া কি ফল? সুতরাং আসন-বদ্ধ হইয়া হিন্দু ধ্যানে মগ্ন হইল, স্বপ্ন দেখিতে লাগিল। কাহার স্বপ্ন? কাহার ধ্যান?—ব্রহ্মের ধ্যান। ব্রহ্মের ধ্যানই মুক্তি। আমিই ব্রহ্ম—ব্রহ্ম মায়ায় বদ্ধ হইয়াই আপনাকে বহুধা করিয়া দেখেন—এই মায়া-দর্পণ হইতে বিমুখ হইলেই, ব্রহ্ম স্বস্বরূপে ফিরিয়া আইসেন, তখন ব্রহ্মের সহিত আমিও যুক্ত হই। অতএব ‘সোহহং ব্রহ্ম’ এই মন্ত্র উচ্চারণ কর। ‘কারণ, যিনি আপনাকে ব্রহ্ম বলিয়া জানেন, তিনি ব্রহ্মের সহিত এক হইয়া যান। এস আমরা, এই কুজ্‌ঝটিকা-সমাচ্ছন্ন আবির্ভাবসমূহের মধ্য হইতে, সেই ‘তৎসৎ’কে জানিতে চেষ্টা করি, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমাদের সীমাবদ্ধ জীবনের সকল প্রতিবন্ধক দূর হইবে, আমরা পুনর্ব্বার অনাদি অনন্তস্বরূপে পরিণত হইব—যেখান হইতে আমরা আসিয়ছিলাম, সেইখানেই আবার ফিরিয়া যাইব। এবড় অদ্ভূত ব্যাপার, কুত্রাপি এ কথা শুনা যায় না যে, কর্ম্মে মুক্তি নাই, বিশ্বাসে মুক্তি নাই, ভাবে মুক্তি নাই, ক্রিয়াকলাপে মুক্তি নাই, পরন্তু জ্ঞানেই মুক্তি। ‘যাহাদিগের চরিত্র বিশুদ্ধ, যাহারা বেদ পাঠ করে, যজ্ঞানুষ্ঠান করে, মৃত্যুর পরে তাহারা দেব-লোক গমন করে, কিন্তু তাহাদিগের সঞ্চিত পুণ্য শেষ হইয়া আসিলে, তাহারা আবার ইহলোকে ফিরিয়া আইসে, কারণ, তাহারা সত্যকে জানে না। তাহারা নূতন আকারে জন্মগ্রহণ করে, আবার কামনা করে, ইচ্ছা করে, কর্ম্ম করে, অনুভব করে, জীবন ধারণ করে। ... ... ... যে ব্যক্তি ব্রহ্ম ও জগতের মধ্যে প্রভেদ দেখে, সে পরিবর্ত্তন হইতে পরিবর্ত্তনে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুতে উপনীত হয়।’ অর্থাৎ তাহাদিগের পুনঃ পুনঃ জন্ম হয়। চিরশান্তি লাভ করিতে চাও ত নিঃশ্বাসকে রুদ্ধ কর, চিত্তকে একাগ্র কর, ইন্দ্রিয়গণকে নিগ্রহ কর—বাক্যকে স্তম্ভিত কর। তালুদেশে জিহ্বাগ্র চাপিয়া রাখ, ধীরে ধীরে শ্বাস ত্যাগ কর, আকাশে কোন বিন্দুর উপর লক্ষ্য স্থির কর; তাহা হইলে চিন্তা রহিত হইবে, চেতনা বিলুপ্ত হইবে, আমিত্ব ঘুচিয়া যাইবে। ‘সুখদুঃখ আর অনুভব হইবে না, পরে প্রশান্তি ও কৈবল্যে উপনীত হইবে।’ আত্মা যখন পরমাত্মাকে চিনিতে পরিবে তখন আর তাহার আকাশ থাকিবে না, কাল থাকিবে না, সংখ্যা থাকিবে না, সীমা থাকিবে না, গুণ থাকিবে না। ‘লূতাতন্তু যেরূপ আপনার তন্তু অবলম্বন করিয়া মুক্ত আকাশে উত্থিত হয়, সেইরূপ যেব্যক্তি ওঁকার অবলম্বন করিয়া ধ্যান করে সে মুক্তিলাভ করে।’ ‘যিনি মনহীন, অথচ মনের অভ্যন্তরে অবস্থিত, যিনি প্রচ্ছন্ন অথচ সকলের মূলে বিরাজমান, তাঁহাতে চিত্ত নিমগ্ন কর, আত্মার সকল গ্রন্থি ছিন্ন হইয়া যাইবে।’ মন ও ইচ্ছা ধ্বংস হইলেই মায়ার সমস্ত ইন্দ্রজাল তিরোহিত হয়। ‘তখন আমরা ধূম-হীন অগ্নির ন্যায় প্রতীয়মান হইব, রথকে পরিত্যাগ করিয়া আরোহী যেরূপ রথের চক্রঘূর্ণন নিরীক্ষণ করে, আমরা তখন সেইরূপ হইব’—‘দুঃখ আমাদের অন্তরে আর থাকিতে চাহিবে না; যেব্যক্তি ব্রহ্মকে জানে, সে চিরশান্তি প্রাপ্ত হয়? যখন আমরা জানিলাম, আমরা সেই পূর্ণ জ্যোতিঃস্বরূপের স্ফুলিঙ্গ, তখন আর কে আমাদিগকে দুঃখ দিতে পারে? তখন আর এ কথা বলি না, ‘এই শরীরই আমি, কিম্বা আমি অমুক’, কিন্তু বলি, ‘আমিই ব্রহ্ম, আমিই জগৎ।’ তখন আর আমরা ‘গুণ-তরঙ্গে’ নায়মান বা বিচলিত হই না। ... ...

 “অতি সুক্ষ্ম আলোচনার প্রভাবে ব্রাহ্মণের মস্তিষ্ক দার্শনিক ঘূর্ণিরোগে আক্রান্ত; চিন্তার দ্বারা চিন্তার উচ্ছেদ—ইচ্ছার ধ্বংস সাধন, ইহা ত ব্রাহ্মণ্য দর্শনের প্রত্যক্ষ ফল। এই মায়াবাদের-প্রবণতা সেই আদিম বৈদিক যুগে আরম্ভ হইয়া তাহার ফল এতদূর পর্য্যন্ত গড়াইয়াছে। এই পরিণাম অবশ্যম্ভাবী। অন্যত্রও ইহার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। একটি সমস্ত জাতি মায়াবাদে দীক্ষিত—ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও এরূপ দেখা যায় না বটে, কিন্তু যুরোপেও এরূপ ব্যক্তিবিশেষ মধ্যে মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় যাঁহারা হিন্দু-ভাবে অনুপ্রাণিত। ফ্রান্সে, আমাদের একজন বড় কবি, জাঁ লাহর, তিনি অজ্ঞাতসারে হিন্দু; তাঁহার ‘মায়া’ ও ‘নাস্তি’ বিষয়ক গ্রন্থে হিন্দুশাস্ত্রের ভাব জীবন্ত ভাবে লক্ষিত হয়। ইংলণ্ড, যেখানকার লোকেরা এমন সাহসী, এমন উদ্যমশীল, যেখানে আমিত্ব-ভাব এমন স্থায়ী ও বলবৎ, যেখানকার ধর্ম্ম হিব্রুধরণের একেশ্বরবাদ, সেখানেও হিন্দুপ্রাণ ‘শেলি’ উদিত হইয়াছেন। সমালোচকেরা স্পষ্টই দেখাইয়াছেন, শেলির অনেকটা বৈদিক ধরণের কল্পনা ছিল। ... ... তিনিও বৈদিক কবির ন্যায়, আপনাকে বহির্জগতে প্রক্ষিপ্ত করিয়াছেন; তাঁহার কবিতা,—সচল প্রকৃতির সচল প্রতিবিম্ব; যাহাতে ব্যক্তিত্বের অধিষ্ঠান উপলব্ধি হয় এরূপ হৃদয়-ভাব শেলির কবিতাতে বিরল; ‘আমি’ বলিয়া যে একটী অনুভূতি তাহা তাঁহার কবিতাতে অতি অল্পমাত্রায় লক্ষিত হয়। সকল সময়েই, তাঁহার হৃদয়ের উচ্ছ্বাস,—বহিঃপ্রকৃতির হৃদয়ের উচ্ছ্বাস। তাঁহার আত্মা প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র নহে, পরন্তু প্রকৃতিতে ছড়াইয়া আছে। সুতরাং প্রকৃতির সকল পদার্থই তাঁহার নিকট প্রাণবিশিষ্ট, জীবন্ত, বোধবান, গতিশীল ও বিচিত্র রূপধারী। জগতের মূলে তিনি এমন এক আত্মা দেখিতে পান, আমরা যাহার চিন্তাস্বরূপ; যে আত্মা কীটের মধ্যে স্পন্দিত হইতেছে, ও তারকার মধ্যে দীপ্তি পাইতেছে; এমন একটি আত্মা—প্রকৃতি যাহার রহস্যময় পরিচ্ছদ; যাহা সমস্ত দৃশ্যমান পদার্থের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বর্ত্তমান, এবং যাহাকে কখন কখন, কোনও বিরল মুহূর্ত্তে, স্বচ্ছ আবরণ-মধ্যবর্ত্তী ম্লান দীপশিখার ন্যায় সুন্দর আকৃতির ভিতর দিয়া আমরা দেখিতে পাই। ‘শৃঙ্খলামুক্ত প্রমথ’ নামক তাঁহার কবিতাটি পাঠ করিয়া দেখ—যেখানে সমস্ত আত্মা, সমস্ত জীব, একতানে সম্মিলিত হইয়াছে, বিশেষতঃ যেখানে পৃথিবীর সহিত চন্দ্রের কথাবার্ত্তা চলিতেছে—সেই অংশটি পাঠ করিয়া, যে প্রাণ সকল পদার্থের মধ্য দিয়া প্রবাহিত—সেইবিশ্ব-প্রাণের অনন্ত উচ্ছ্বাসে কে না উন্মত্ত হইয়া উঠিবে? বিচিত্র শব্দ, বিচিত্র গন্ধ, বিচিত্র বর্ণ যাহা আমরা বাহিরে দেখি—সমস্তই ব্রহ্মের মায়া; এই মায়ামোহে কে না আচ্ছন্ন হইয়া পড়িবে? কিন্তু শেলি ইহার অধিক যান নাই; শান্ত, নির্গুণ ব্রহ্মকে তিনি দেখিতে পান নাই। হিন্দু বুদ্ধি ও হিন্দু কল্পনা—এই দুই ধাপের মধ্যে একটি ধাপে তিনি পৌঁছিয়াছেন মাত্র। সেটি কল্পনার ধাপ। তিনি বৈদিক কবির স্বপ্নোচ্ছ্বাস, আনন্দোচ্ছ্বাস পর্য্যন্ত পৌঁছিয়াছেন; কিন্তু হিন্দু দাৰ্শনিকের লয়তত্ত্বে পৌঁছেন নাই। তাঁহার অদ্বৈতবাদে বিশ্ব-প্রাণের উচ্ছ্বাস আছে, নির্ব্বাণ নাই। তাঁহার অদ্বৈতবাদ সুস্থ ও সবল।

 “‘আমিয়েল’ আর একটি অপেক্ষাকৃত পূর্ণাবয়ব দৃষ্টান্ত। ইনি সগুণ জীবন্ত ব্রহ্মকে ভেদ করিয়া আরও একটু ভিতরে তলাইয়াছেন। ইনি ব্রহ্মের শান্তস্বরূপে প্রবেশ করিয়া নিস্পন্দ অসাড় হইয়া পড়িয়াছেন; মুক্ত হইয়াছেন। ... ... হিন্দুর নিশ্চেষ্টতা, হিন্দুর বৈরাগ্য, হিন্দুর মায়াবাদ, ইচ্ছা ভাব ও বুদ্ধির এই যে তিন ধাপ, ইনি এই তিন ধাপই মাড়াইয়া আসিয়াছেন। ইনি আপনাকে ব্রাহ্মণদিগের ভ্রাতা বলিয়া স্বীকার করেন। ‘ভারতবর্ষীয় যোগীর ন্যায় আমার আত্মা মায়ার দোলায় আন্দোলিত; আমার নিকট সকলই, এমন কি, আমার নিজের জীবন পর্য্যন্ত, ধূম, বিভ্রম, ও বাষ্পবৎ। এই সকল বিষয়রাশি আলোকের ন্যায় আমার উপর দিয়া চলিয়া যায়, কোন পদচিহ্ন রাখিয়া যায় না—তাহার উপর আমার অল্পই আস্থা। চিন্তা অহিফেনের স্থান অধিকার করিয়াছে; চিন্তা সকলকে উন্মত্ত করিতে পারে, সকল পদার্থকে, এমন কি পর্ব্বতকেও অন্তর্ভেদী স্বচ্ছতা প্রদান করিতে পারে।’ ... ... ... ‘প্রত্যেক সভ্যতা, যুগযুগান্তের স্বপ্নস্বরূপ; ইহাতে আকাশ, পৃথিবী, প্রকৃতি ইতিহাস একপ্রকার অদ্ভুত বিচিত্র আলোকে প্রকাশ পায় এবং বিভ্রম-অভিভূত আত্মার প্রলাপ-নাটকের অভিনয় হইয়া থাকে।’ ... ... ‘উপছায়াকে যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, ধরিতে পারা যায় না, আমি সেইরূপ উপছায়ার ন্যায় তরল পদার্থ। ... ... না মরিয়াও আমি প্রেতের ন্যায়। অন্য সকলে আমার নিকট স্বপ্নের ন্যায়, আমিও অন্যের নিকট স্বপ্নবৎ।’ এই সেই অদ্ভূত অনুভূতি যাহা বংশপরম্পরায় চলিয়া আসিয়া, শুধু ব্রাহ্মণ্য-দর্শন কেন, ব্রাহ্মণ্য-সভ্যতাতেও কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ প্রকটিত করিয়াছে। আমিয়েলের ‘আত্ম-প্রকাশ’ গ্রন্থে, ব্যবহারিক জীবনের একটি কথাও নাই। যেব্যক্তি বিশ্ব-আত্মাকে চিন্তা করে, পূর্ণস্বরূপে মনোনিবেশ করে আগন্তুক ক্ষুদ্র বিষয়-সকল কেমন করিয়া তাহার ভাল লাগিবে? যদি জগৎ মায়াই হইল তবে এরূপ জগতে ভাল স্থান অনুসন্ধান করিবার আবশ্যকতা কি? যদি দৃশ্যমান বাস্তব জগতে আমার কোন আস্থা না থাকে, দৃশ্যমান বাস্তব জগৎও আমাকে আর স্থান দেয় না। ভারতবর্ষে ত ইহার ফল প্রত্যক্ষ দেখা যায়। দর্শন ও জ্যোতিষশাস্ত্র ব্যতীত হিন্দুদিগের আর কোন বিজ্ঞান নাই। প্রকৃতির নিয়ম ও তথ্য অনুসন্ধানে গ্রীকদিগের ন্যায় হিন্দুদিগের কোন কৌতুহল ছিল না; কতকগুলি উপনিষদ্‌ মনে হয়, বাতুলের লেখা, বালকের লেখা। তাহাতে কুকুরেরা ও পক্ষীরা তর্কবিতর্ক করিতেছে, দর্শনশাস্ত্রের আলোচনা করিতেছে, তাহাতে ইতিহাসের কথা আদৌ নাই। এই বৃহদায়তন সাহিত্য কেবল স্বপ্ন ও দর্শনের জটিলতায় পূর্ণ। কোন একটি ঘটনার তারিখ, কোন গম্ভীর বিষয়ের উপাখ্যান বা কোন বংশাবলীর কথা ইহাতে কিছুই নাই। আসিয়ার বড় বড় ধর্ম্মমূলক ঘটনার বিষয় যাহা কিছু জানা যায় তাহা প্রায়ই চীন পরিব্রাজকদিগের নিকট হইতে। বৌদ্ধধর্ম্ম কখন্‌ ভারতে আরম্ভ হইল, কখনই বা ভারত হইতে অন্তৰ্হিত হইল কিছুই জানিতে পারা যায় না। সত্যই যদি সমাজ ও সমাজের সভ্যতা—(যেমন আমিয়েল বলেন, আত্মার মূর্ত্তিমান স্বপ্নমাত্র,) ব্রহ্মসাগরে উৎক্ষিপ্ত ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গমাত্র, তবে এমন বাতুল কে আছে যে, সভ্যতার ইতিহাস, সমাজের ইতিহাস লইয়া মস্তিষ্ক আলোড়ন করিবে?

 “... ... ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম যদি একবার প্রতিষ্ঠিত হইল, দার্শনিক স্বপ্নের একবার যদি আরম্ভ হইল, তাহা হইলে বহিঃশত্রুর আক্রমণ আর কিরূপে প্রতিরুদ্ধ হইবে? প্রাচীন ভারতের নাগরিক ব্যবস্থা-বন্ধন, সামরিক ব্যবস্থা-বন্ধন, রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা-বন্ধন সকলই অসম্পূর্ণ, কিছুরই নির্দ্দিষ্ট আকার নাই, সমস্ত হিন্দুজাতি “জেলির” ন্যায় থল্‌থলে, অস্পষ্ট, অসম্বদ্ধ, দুর্ব্বল; কাজেই মুসলমান ইংরাজ যে কেহ প্রথম আসিয়া আক্রমণ করিল, সেই অনায়াসে জয়লাভ করিল। হিন্দুর তাহাতে কি আসে যায়? যাহা প্রকৃত সত্য, যাহার ধ্যানে ভবযন্ত্রণা হইতে মুক্ত হওয়া যায়, তাহারই স্বপ্নে মগ্ন হইতে দাও, তাহা ধ্যান করিতে দাও, শান্তিদায়ী ওঁকারের আবৃত্তি করিতে করিতে সেই পরমাত্মার ধ্যানে মত্ত হইতে দাও, তাহা হইলেই হইল, হিন্দু আর কিছুই চাহে না।”