মাতৃ-স্নেহ ও ঈশ-স্তুতি/মাতৃ-স্নেহ

উইকিসংকলন থেকে


মাতৃ-স্নেহ।


দশ মাস করি মা গো উদরে ধারণ,
সহিয়াছ কত কষ্ট আমার কারণ।
অসহ্য প্রসব-ব্যথা সকলি ভুলিলে,
হবামাত্র যবে মোরে কোলেতে করিলে।
আপনার মন-সুখ দিয়া বিসর্জ্জন,
পালিয়াছ মোরে মা গো করিয়া যতন।
স্থির হও নাই মোরে পালঙ্কে রাখিয়া,
শত বার দেখিতে মা নিকটে আসিয়া।
কাঁদিলে অমনি নিতে হৃদয়ে তুলিয়া,
সান্ত্বনা করেছ মা গো দুগ্ধদান দিয়া।
আধ আধ কথা যবে ফুটিল আমার,
তাহা দেখি কত সুখ অন্তরে তোমার!
যখন আমাকে মা গো কোলেতে করিতে,
"সে কথাটি বল বাবা” কেবলি বলিতে।

অত্যল্প চলিতে আমি শিখিনু যখন
দিবানিশি হস্তে ধরি চলাতে তখন।
অসহায় শিশুকাল যবে হলো শেষ,
তখন করেছ যত্ন আমাকে অশেষ।
অন্ধকারে যেতে মোরে দাওনি কখন,
পাছে সর্প আসি মোরে করয়ে দংশন,
অহোরাত্র আমাকে মা নিকটে রাখিয়া,
কতই জ্ঞানের শিক্ষা দিয়াছ বসিয়া।
কাহার নিকটে যেতে দাওনি আমায়
পাছে কোন মন্দ রীতি আমাকে শিখায়।
সর্ব্বদা ভাবনা মনে হইত তোমার,
কি প্রকারে হিতবুদ্ধি হইবে আমার।
গৃহকর্ম্মে অবকাশ পাইতে যখনি,
আমা প্রতি নীতিশিক্ষা দিতে গো তথনি।
করিতে যখন মাগো ঈশ উপাসনা,
আমার মঙ্গল অগ্রে করিতে কামনা।
স্নেহ পরিপূর্ণ মরি জননী মতন,
কে আছে ধরণী তলে, কে আছে এমন!

কবে হবে মা গো সেই সুদিন আমার,
হেরিয়া হইব সুখী চরণ তোমার।
কি আর জানাব মা গো জন ত সকল,
জননীর সেবা বিনা জীবন বিফল।
তব পদে ভক্তি যেন থাকে অনুক্ষণ,
তাহলে সার্থক হবে এ পাপ জীবন।
অসার মনুষ্য দেহ হয় মা তাহার,
দিবা-রাত্রি সেবা যে না করিবে মাতার।
আমি কি করেছি মা গো তপস্যা এমন,
জীবন কাটাব মা গো সেবি ও চরণ।
জননী সমান ধন এ জগতে নাই,
স্বৰ্গ মর্ত্ত সুখ যদি হয় এক ঠাঁই।
আহা মরি জননী গো তব ঋণভার,
সুধিতে পারিব কি মা ইহ জন্মে আর?
শতধার পয়ঃপান করেছি তোমার,
সুধিতে নারিনু মা গো তার এক ধার।
যে কষ্ট করিয়া তুমি করেছ পালন,
কখন না ভুলিব মা থাকিতে জীবন।

হৃদয় খুলিয়া যদি দেখাই তোমায়,
দেখিবে মা ও চরণ অঙ্কিত তাহায়।
যত প্রিয় বস্তু আছে ভারত ভিতর,
মাতৃসম কিছু তাহা নহে তৃপ্তি-কর।
অতুল ঐশ্বর্য্যশালী যদি লোকে হয়,
মাতৃহীন হলে সুখ কিছুতেই নয়।
শান্তি-প্রদায়িনী মরি জননী মতন,
আর নাহি বিধি কারে করিলা সৃজন।
কিবা পশু কিবা পক্ষী যা দেখিতে পাই,
সন্তানে করিতে যত্ন কার(ও) ক্রটি নাই
আহা মরি পক্ষী-মাতা সন্তান কারণ,
দিবানিশি চতুর্দ্দিকে করিছে ভ্রমণ।
কুলায়ে শাবক রাখি আহারান্বেষণে,
প্রতিদিন যায় মাতা কতই যতনে।
বিরক্ত না হয় কভু উড়িয়া উড়িয়া,
আহার মিলিলে আসে অমনি দৌড়িয়া।
এত স্নেহ মার হৃদে কেন বা হইল,
সন্তানে করিতে এত কে বলিয়া দিল?

জননীর স্নেহ দেখি আশ্চর্য্য হইয়া,
দিবানিশি হৃদি মোর উঠিছে কাঁদিয়া।
কি করিয়া মাতৃধার করিব শোধন,
কি রূপে হইবে মোর পাপ বিমোচন।
মিথ্যা এ মনুষ্য দেহ মোর হয়েছিল,
জননী জনমভূমি চিনিতে নারিল।
কিছু নাহি পারিলাম করিতে মাতার,
মরণান্তে প্রতিফল পাইব ইহার।
মরি মরি কি আশ্চর্য্য জননী-হৃদয়,
বর্ণিতে তাঁহার গুণ মম সাধ্য নয়।
এত স্নেহ যদি মার হৃদে না হইবে,
তবে কেন বসুন্ধরা পাপেতে ডুবিবে।
কেন বা হইবে তবে অকাল মরণ!
ঘটিত কি ধরাতলে এত অলক্ষণ?
অদ্ভূত জন্মের কথা সকলি ভুলিয়া,
মিথ্যা দিন কাটিতেছি জগতে অসিয়া।
দুচক্ষু মেলিয়া যবে করি দরশন,
দেখিয়া মাতার স্নেহ যুড়ায় নয়ন।

হায় হায় এই পাপে কি হবে তামার,
বিন্দুমাত্র পারি নাই হুধিতে সে ধার॥



মধুময় দুগ্ধ পান করেছি কাহার,
কে রাখিত শোয়াইয়া কোলে আপনার,
কে চুম্বন দিলে সুখ হইত অপার?
স্নেহময়ী জননী তামার!

নিদ্রাভঙ্গ যবে মোর হইয়া যাইত,
কেবা মৃদুম্বরে গীত তখন গাইত,
রোদন না করি যাতে সে রূপ করিত?
স্নেহময়ী জননী আমার!

কে বসিয়া রক্ষা মোরে করেছে তখন,
হস্ত-পদ-শূন্য আমি ছিলাম যখন,
স্নেহ অশ্রু পরিপূর্ণ কাহার নয়ন?
স্নেহময়ী জননী আমার!

কাঁদিতাম যবে রোগে অস্থির হইয়া,
কে থাকিত এক দৃষ্টে আমাকে চাহিয়া,

অমঙ্গল ভাবি কেবা কাঁদিত বসিয়া?
স্নেহময়ী জননী আমার!

পতিত দেখিলে মোরে কেবা উঠাইত,
কি হইল বলি কেবা দৌড়িয়া আসিত,
ক্ষত স্থানে চুম্ব দিয়া কষ্ট নিবারিত?
স্নেহময়ী জননী আমার!

আধ আধ স্বরে আমি করি উপাসনা,
শিখিলাম বাল্যকালে ঈশ্বর ভজনা।
কে শিখাত অহোরাত্র বুদ্ধি বিবেচনা?
স্নেহময়ী জননী আমার!

মা তোমার ভালবাসা কখন না ভুলিব,
করিব মা স্নেহ ভক্তি যত দিন বাঁচিব।
মালা গাঁথি তব নাম হৃদি মাঝে পরিব,
স্নেহময়ী জননী আমার!

হেন দিন কবে হবে মার ঋণ সুধিব,
মন-সুখে মার মুখে অন্ন জল তুলিব।

সেবিয়া মাতার পদ সুখ নীরে ভাসিব,
স্নেহময়ী জননী আমার!

আছে সাধ নিবাইব স্নেহ বারি দিয়া,
যত দুখ পেয়েছ মা আমার লাগিয়া
তব আশীর্ব্বাদে যদি থাকি গো বাঁচিয়া,
স্নেহময়ী জননী আমার!

পালঙ্ক উপরে আমি তোমাকে রাখিয়া,
দিবানিশি বিভুনাম করিব বসিয়া,
মনের যতেক দুখ যাইব ভুলিয়া।
স্নেহময়ী জননী তামার!

তোমার সেবায় মা গো মোর পাপ মন,
অমৃত সলিলে যেন করে সন্তরণ।
হার মানে তোমা কাছে অমর ভবন,
স্নেহময়ী জননী আমার!


শত পুত্র যদি হয়, জননী সমান নয়,
জানে ইহা সকল সংসার।
বড়ই অভাগা যেই, এ ধ’নে বঞ্চিত সেই
কোন সুখ নাহিক তাহার।
মার মত স্নেহ করে এ জগতে নাহি আর,
সাধ্য কার কে পারে করিতে?
দেখিলে মাতার মুখ, দূরে যায় যত দুখ,
শোক তারে না পারে ঘেরিতে।
পাপিষ্ঠ সন্তান যত, মাকে কষ্ট দেয় কত,
তবু স্নেহ নাই যায় মার।
কিসে তার ভাল হবে, কি করিয়া সুখে রবে,
সর্ব্বদাই ভাবনা তাঁহার।
সন্তান সুখী হইলে, ভাসে মা সুখ সলিলে,
আপনার দুখ ভুলি যান।
মাতা কন্যা পুত্র তরে, পূজেন পরমেশ্বরে,
হইবারে তাদের কল্যাণ।
দেখিলে সন্তান-দুঃখ, ঘুচে যায় মার সুখ,
শোকসিন্ধু উঠে উথলিয়া।

শত সূচিকার মত, ফুটে হৃদে অবিরত,
দিবানিশি কাঁদেন বসিয়া।
কেবল করেন হায়! সংসার শ্মশান প্রায়,
কিছুতেই সুখ নাহি মার।
যে দিকে চান ফিরিয়া, হৃদয় উঠে কাঁদিয়া,
শক্তি নাহি থাকে উঠিবার।
অশ্রুজলে ভাসি যান, দিবানিশি মুখ ম্লান
করেন অদৃষ্টে তিরস্কার।
হেন দুখের সন্তান নাহি রাখে মার মান,
সেই পাপে পুড়িল সংসার।
মাতি যে করেন এত তথাপি সন্তান কত
দহিতেছে মাতার অন্তর,
ফেলেনা মা চক্ষু-জল পাছে হয় অমঙ্গল
মন দুখ করেন অন্তর।


ওরে পাপ মন করি নিবেদন,
জননীরে সদা করিবে যতন।
তবেত তোমার হইবে উদ্ধার,
যমদণ্ড আর হবে না কখন।

জগত দেখিলে কারণে যাঁহার,
তাঁরে শিরোপরি রাখ আপনার।
স্বর্গে বাস হবে মন সুখে রবে,
কখন যন্ত্রণা হবে না তোমার।

এত সুখী হলে কাহার কারণ,
তাহা একবার করিও স্মরণ।
নিজ সুখ নিয়ে থেক না ভুলিয়ে,
তাঁরে সেব, জিনি সুখের কারণ।

মাকে ভক্তি শ্রদ্ধা অবিরত কর,
তবেত যাইবে অমর নগর।
দুঃখ না পাইবে আনন্দে ভাসিবে,
নিরানন্দ কভু হবে না অন্তর।

ধোও মার পদ ভক্তি নীর দিয়া,
কর পূজা তাঁর প্রীতি পুষ্প নিয়া।
তা হলে তোমার মৃত্যু ভয় আর,
হইবে না শেষে পরলোকে গিয়া।

মাতার সেবায় মতি আছে যার,
কতু অমঙ্গল ঘটিবে না তার।
জানে সেই জন জননী কি ধন,
নাহি পুণ্যমতি তার সম আর।

গুরু আর নাই জননী সমান,
তাঁহার সেবায় হবে পরিত্রাণ।
ত্যজি অন্য ব্রত পূজ অবিরত,
তা হলে তুমিই সার্থক সন্তান।

শুনেছি মন্দার তরু নন্দন কাননে,
বর নাকি দেয় সেই যার যাহা মনে।
চল মা গো চল যাই, এই ভিক্ষা তারে চাই,
চিরদিন থাকি যেন একত্রে দুজনে।

অবনীর পাপ চক্র সকলি ত্যজিয়া,
তথায় যাইব মা গো দুজনে মিলিয়া।
সুরলোকে মন্দাকিনী মোক্ষপদ প্রদায়িনা,
দিবে মা তোমাকে বর করুণা করিয়া।

শঠতা চাতুরী ছল মহীতল প্রায়,
বিন্দুমাত্র অন্য কিছু দেখা নাহি যায়।
অপ্সরী কিন্নরী যত, বিভূগানে আছে রত,
থাকিলে তাদের সাথে যুড়াবে হৃদয়।

ধরিয়া যোগিনী বেশ করিব ভ্রমণ,
হেরিয়া ত্রিলোক-নাথে যুড়াব নয়ন।
দিবা নিশি এক মনে, বসিয়া মা তুই জনে,
হৃদয়ের মাঝে তাঁরে করিব স্মরণ।

গরল সংসার ত্যজি, অমৃত আগারে
এস গো জননী যাই লইয়া তোমারে।
পাপ তাপ পরিহরি, তোমারে সঙ্গিনী করি,
রব গো যথায় শোক প্রবেশিতে নগরে!