পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেদিন বিলাসের আগমন-সংবাদে কন্যার মুখের উপর যে আরক্ত আভাটুকু দেখা দিয়াছিল, বৃদ্ধকে তাহা ব্যথাই দিয়াছিল।

বিলাসবিহারী রাসবিহারীর পুত্র। সে এই কলকাতা শহরে থাকিয়া বহুদিন যাবৎ প্রথমে এফ. এ. এবং পরে বি. এ. পড়িতেছে। বনমালী সমাজ ত্যাগ করিয়া অবধি বড় একটা দেশে যাইতেন না। যদিচ ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও জমিদারি অনেক বাড়াইয়াছিলেন, কিন্তু সে-সমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার বাল্যবন্ধু রাসবিহারীর উপরেই ছিল।

সেই সূত্রেই বিলাসের এ বাটীতে আসা-যাওয়া আরম্ভ হইয়া কিছুদিন হইতে অন্য যে-কারণে পর্যবসিত হইয়াছিল, তাহা পরে প্রকাশ পাইবে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মাস-দুই হইল বনমালীর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার কলিকাতার এত বড় বাড়িতে বিজয়া এখন একা। তাহার দেশের বিষয়-সম্পত্তির দেখাশুনা রাসবিহারীই করিতে লাগিলেন, এবং সেই সূত্রে তাহার একপ্রকার অভিভাবক হইয়াও বসিলেন। কিন্তু নিজে থাকেন গ্রামে, সেইজন্য পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারির ভার পড়িল। সে-ই তাহার প্রকৃত অভিভাবক হইয়া উঠিল।

তখন এই সময়টায়, প্রতি ব্রাহ্মপরিবারে ‘সত্য’, ‘সুনীতি’, ‘সুরুচি’ এই শব্দগুলা বেশ বড় করিয়াই শিখানো হইত। কারণ বিদেশে পড়িতে আসিয়া হিন্দু যুবকেরা যখন পিতামাতার বিরুদ্ধে, দেবদেবীর বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া এই সমাজের বাঁধানো খাতায় নাম লিখাইয়া বসিত, তখন এই শব্দগুলাই চাড়া দিয়া তাহাদের কাঁচা মাথা ঘাড়ের উপর সোজা করিয়া রাখিত—ঝুঁকিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে দিতো না। তাহারা কহিত, যাহা সত্য বলিয়া বুঝিবে, তাহাই করিবে। মায়ের অশ্রুজলই বল, আর বাপের দীর্ঘনিশ্বাসই বল, কিছুই দেখিবার শুনিবার প্রয়োজন নাই। ও-সব দুর্বলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করিবে, নচেৎ আলোকের সন্ধান পাইবে না। কথাগুলা বিজয়াও শিখিয়াছিল।

আজ গ্রাম হইতে বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যু-সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন। বিজয়ার সে পিতৃবন্ধু বটে, কিন্তু বিলাসবাবু যখনই বলিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া জগদীশ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া ছাদের উপর হইতে পড়িয়া মরিয়াছে, তখন ব্রাহ্মধর্মের সুনীতি স্মরণ করিয়া বিজয়া এই দুর্ভাগা