এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা/বিবাহ

উইকিসংকলন থেকে

বিবাহ।

 পূর্বে স্ত্রীলোকেরা পতিমর্য্যাদা বিশেষরূপে জ্ঞাত না হইলে বিবাহ করিতেন না। শাস্ত্রে লেখে “কন্যা যত দিন পতিমর্য্যাদা ও পতিসেবা না জানে এবং ধর্ম্ম শাসনে অজ্ঞাত থাকে, তত দিন পিতা তাহার বিবাহ দিবেন না।” যে সকল সদ্যোবধূর উপাখ্যান বর্ণিত হইয়াছে, তাঁহারা যৌবনাবস্থায় বিবাহ করিয়াছিলেন। যুবক ও যুবতী পরস্পর সন্দর্শন করিয়া ও পরস্পরের স্বভাব, চরিত্র, গুণ ইত্যাদি জানিয়া, পিতা মাতার অনুমতি অনুসারে বিবাহ করিতেন। রামচন্দ্রের বনবাস কালীন অযোধ্য সর্ব্বপ্রকারে নিরানন্দে মগ্ন ছিল। বাল্‌মীকি লেখেন, যে সকল উদ্যানে যুবক ও যুবতী আমোদার্থে ও পরস্পর সন্দর্শনার্থে গমন করিতেন, তাহা এক্ষণে শূন্য রহিল।

 ক্ষত্রিয়েরা বীরত্ব সম্মানার্থে কন্যাকে স্বয়ংবরা করিয়া বিশেষ বিশেষ পণ করিতেন। রাম, ধনু ভঙ্গ করিয়া সীতাকে বিবাহ করেন। অর্জ্জুন, লক্ষ্য ভেদ করত দ্রৌপদী লাভ করেন। স্বয়ম্বর সভায় কন্যা, ধাত্রির নিকট সকলের পরিচয় পাইয়া ও রূপ দেখিয়া, যাঁহার প্রতি মনন করিতেন, তাঁহার গলায় বরমাল্য দান করিতেন।

 রঘুবংশে ৬ষ্ঠ সর্গে ইন্দুমতীর, ও নৈষধের ২১ সর্গে দময়ন্তীর স্বয়ম্বরের বিবরণ লিখিত আছে।

 পূর্ব্বে কন্যা, স্বয়ম্বর না হইয়াও ইচ্ছামত পাত্রে পাণি প্রদান করিতেন যথা—সাবিত্রী, দেবযানি, রুক্মিণী, শুভদ্রা ইত্যাদি। দশকুমারে লেখে যে, কন্যা সুশিক্ষিত হইয়া আপন স্বেচ্ছাক্রমে বর গ্রহণ করিতেন।

 বিবাহ অষ্ট প্রকার ছিল।

 ১। ব্রাহ্ম—সুপাত্রে কন্যা দান।

 ২। দৈব—পুরোহিতকে কন্যা দান।

 ৩। ঋষি—দুইটা গরু পাইয়া কন্যা দান।

 ৪। প্রজাপত্য—সম্মান পূর্ব্বক কন্যা দান। পিতা এই আশীর্ব্বাদ করিতেন—বর কন্যা তোমরা দুই জনে মিলিত হইয়া ঐহিক ও পারত্রিক কর্ম্ম করিবে।

 ৫। আসুর—ধন পাইয়া কন্যা দান।

 ৬। গান্ধর্ব্ব—বর ও কন্যার স্বেচ্ছামতে বিবাহ।

 ৭। রাক্ষস—কন্যাকে বলপূর্ব্বক হরণ করিয়া বিবাহ।

 ৮। পৈশাচ—কন্যা নিদ্রিত, উন্মত্ত অথবা ক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকিলে, তাহার সহিত বিবাহ।

 প্রথম ছয় ব্রাহ্মণদিগের, শেষ চারি ক্ষত্রিয়দিগের, ও পঞ্চম এবং ষষ্ঠ প্রকার বিবাহ অন্যান্য শ্রেণীর জন্য বিধিত হইয়াছিল।

 উচ্চ জাতিস্থ লোকেরা নিম্ন জাতিকে বিবাহ করিতে পারিত। ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিবাহ করিত।

 ব্রাহ্মণের কন্যা, নীচ জাতিকে বিবাহ করিলে তাহাকে কেহ পরিত্যাগ করিতে পারিত না। তিনি স্বামীর সহিত সকল বৈদিক কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। ব্রাহ্মণের সুদ্রানী ভার্য্যা হইলে, তিনি সকল বৈদিক কার্য্যে গৃহীত হইতেন না। ব্রাহ্মণের নানা বর্ণীয় স্ত্রী থাকিলে, উপাসনা প্রভৃতি তাহাদিগের বর্ণানুসারে হইত। যদি কোন স্ত্রী, উচ্চ জাতীয় ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করিত, তাহা হইলে দণ্ডনীয় হইত আর নীচ জাতীয় লোকের প্রতি লক্ষ্য, করিলে, বাটীতে রুদ্ধ থাকিতে হইত। এই নিয়ম কত দূর প্রবল ছিল, তাহা বলা কঠিন, কারণ অসবর্ণ বিবাহ পূর্ব্বে প্রচলিত ছিল।

 উত্তম স্ত্রীর লক্ষণ, মনু বলেন—জ্ঞান, ধর্ম্ম, পবিত্রতা, মৃদুবাক্য, ও নানা শিল্পবিদ্যায় পারদর্শিতা। এবম্প্রকার অঙ্গনা, রত্নের ন্যায় উজ্জ্বল হয়েন। মনু ও ভীষ্ম বলেন যে, নীচ জাতিতে উত্তম স্ত্রীলোক থাকিলে, তিনিও উচ্চ জাতি দ্বারা গ্রহণীয়। বিবাহে কন্যার সম্মতির আবশ্যক হইত। বিবাহ কালীন, বর কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিতেন তোমাকে কে দিতেছেন—প্রেম অথবা আপন ইচ্ছা? উত্তর প্রেম দাতা, প্রেম গৃহীতা। তাহার পর, বর বলিতেন—তোমার চিত্ত আমার চিত্ত হউক। বিবাহের এক নিয়ম এই যে, স্ত্রী পুরুষ পরস্পরের প্রতি শুদ্ধাচার অনুষ্ঠান পূর্ব্বক বৈবাহিক শপথ রক্ষা করিবেক। রণে, যদ্যপি রাজা শক্রর কন্যাকে জয় লাভ করিয়া আনিতেন, তথাপিও তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে তাহাকে বিবাহ করিতে পারিতেন না। পূর্ব্বে কোন কোন বিদূষী এই পণ করিতেন, যাহারা তাহাদিগকে পাণ্ডিত্যে পরাজয় করিতে সামর্থ হইবেন, তাহাদিগের গলায় তাহারা বরমাল্য অপর্ণ করিবেন। এ কারণ স্ত্রী লাভ করিতে হইলে পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হইত। ক্রমে বিদ্যার অনুশীলন এতদূর হইয়াছিল যে, কোন কোন রাণী পণ্ডিতদিগের সহিত শাস্ত্রীয় আলাপ করিতেন। কর্ণাটের রাণী এইরূপ বিদ্যার চর্চ্চা করিতেন ও কাশ্মীরের রাণী সামদেবকে কথাসরিত সাগর লিখিতে আদেশ করেন। এক বিবাহ শ্রেয়ঃকল্প ও বহুবিবাহ করা শ্রেয়ঃকল্প নহে। রামায়ণ ও মহাভারতে লেখে, এক পত্নী গ্রহণই উৎকৃষ্ট প্রথা ও উচ্চগতি প্রদ—স্ত্রীর নামই ধর্ম্মপত্নী, কারণ স্ত্রীর সহিত ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল সাধনে পুরুষ নিযুক্ত থাকিবে। এক পত্নী হইলে, পুরুষ তাহাকে আপন হৃদয় সম্পূর্ণরূপে অর্পণ করিয়া তাহার সহিত বন্ধন ক্রমশঃ দৃঢ়ীভূত করিবেক। অবশেষে, স্মৃতিকারকেরা এই ধার্য্য করিলেন, যে স্ত্রী সুরাপায়ী, অধার্ম্মিক, মন্দকারিণী, অপ্রিয়া, বন্ধ্যা, চিররোগী অথবা অপব্যয়ী হইলে, অন্য স্ত্রী গ্রহণীয় হইতে পারে, কিন্তু যদি প্রথম স্ত্রী, ধার্ম্মিকা ও পীড়িতা হয়েন, তবে তাঁহার অনুমতি লইয়া দ্বিতীয় বিবাহ হইত।