বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধসাধনা (দ্বিতীয় প্রস্তাব)

উইকিসংকলন থেকে
বৌদ্ধসাধনা
(দ্বিতীয় প্রস্তাব)

 বৌদ্ধসাধনার গোড়াকার কথা অবিদ্যার সহিত সংগ্রাম। বোধিদ্রুমতলে মহাপুরুষ বুদ্ধ যে দিন সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিলেন, সেদিন মানবজীবনের কোন্‌ দুর্জ্ঞেয় রহস্য তাঁহার নিকট উদ্‌ঘাটিত হইল? তিনি তাঁহার নবলব্ধ প্রজ্ঞা-দৃষ্টির দ্বারা দেখিলেন—অবিদ্যা হইতে সংস্কার, সংস্কার হইতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান হইতে নামরূপ, নামরূপ হইতে ষড়ায়তন, ষড়ায়তন হইতে স্পর্শ, স্পর্শ হইতে বেদনা, বেদনা হইতে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা হইতে উপাদান, উপাদান হইতে ভব, ভব হইতে জন্মলাভ হয়। এই জন্ম হইতেই মানব রোগ শোক জরা ব্যাধি মৃত্যু ও দুঃখের যন্ত্রণা ভোগ করিয়া থাকে।

 মানবের এই মহদ্দুঃখের অস্তিত্ব, ইহার উৎপত্তির কারণ এবং নিবৃত্তির উপায়-নির্দ্ধারণেই মহাপুরুষ বুদ্ধের প্রতিভা প্রকাশ পাইয়াছে। অবিদ্যাকেই তিনি মূলব্যাধি বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। এই অবিদ্যার বিনাশ হইলেই ইহ-জীবনেই মানব নির্ব্বাণ লাভ করিতে পারেন। বুদ্ধদেব ধম্মপদে বলিয়াছেন—অবিজ্জা পরমং মলং।

 তিনি সাধককে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন:—এতং মলং পহত্বান নিম্মলা হোথ ভিক্‌খবো। হে ভিক্ষুগণ, এই মলিনতা ত্যাগ করিয়া নির্ম্মল হও। এই অবিদ্যার বিনাশের জন্যই তিনি অষ্ট আর্য্য মার্গ নির্দ্দেশ করিয়াছেন। ইহারই সহিত সংগ্রামের জন্য সাধক মৈত্রী করুণা ও মুদিতা ভাবনা অবলম্বন করেন; এই জন্যই তিনি মানব-জীবনের অপরিহার্য্য দুঃখ এবং সমগ্র প্রাণীর মূল ঐক্য চিন্তা করিয়া থাকেন। শীলগ্রহণেরও তাৎপর্য্য ঐ নিকৃষ্টতম মলিনতার বা অবিদ্যার বিনাশ।

 অংশতঃ এই অবিদ্যাকেই পরাভূত করিয়া সাধক যখন সাধনার ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখনও পাপপ্রলোভনের নানামূর্ত্তি ধরিয়া এই অবিদ্যাই তাঁহাকে নানা দিক হইতে আক্রমণ করিয়া থাকে। সাধক জানেন, অবিদ্যা তাঁহাকে বিশ্ব হইতে বিমুক্ত করিয়া ক্ষুদ্র “অহং” এর সংকীর্ণ প্রাচীর মধ্যে আটক করিয়া রাখিয়াছে; মাঝে মাঝে চকিতের ন্যায় তিনি তাঁহার আপনার সেই বৃহৎ সত্তা অনুভব করেন বটে, কিন্তু সাধারণতঃ তিনি তাঁহার ক্ষুদ্র সত্তাকেই সত্য বলিয়া মনে করেন। অবিদ্যার বশে প্রবর্ত্তকের মনে এই সময়ে কখনো কখনো স্বীয় অবলম্বিত আর্য্যমার্গের প্রতি অবিশ্বাস জন্মিয়া থাকে; আবার কখনো সদ্‌ধর্ম্ম ও শুভ প্রচেষ্টার উপর শ্রদ্ধা হারাইয়া, তিনি একান্ত অধীর হইয়া উঠেন। এই সংশয়দোদুল্যমান চিত্ত লইয়াই তাঁহাকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইতে হয়। তিনি অনলস হইয়া—

অভিথ্‌থরেথ কল্যাণে পাপা চিত্তং নিবারয়ে—

মনের পাপ ধুইয়া-মুছিয়া কল্যাণের দিকে প্রাণপণে ধাবিত হইতে থাকেন। তাঁহার শুভ উদ্যম এবং তাঁহার দৃঢ়তা একটির পর একটি করিয়া সংশয়-গ্রন্থিগুলি উন্মোচন করিতে থাকে। তাঁহার সাধনপথে বাধার অন্ত নাই; ভোগলালসা ঐহলৌকিক এবং পারলৌকিক সুখেচ্ছা ও অহংকার তাঁহার সম্মুখে সুদৃঢ় প্রাচীররূপে উপস্থিত হয়। তিনি শীলপালনে ও ধর্ম্মপ্রচেষ্টায় অবিচলিত থাকিয়া, ইহাদের সহিত সংগ্রাম করিতে করিতে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইতে থাকেন। দিনের পর দিন তাঁহার অধ্যবসায়ের প্রভাবে ক্রমশঃ বাধাগুলি ভূমিসাৎ হইতে থাকে। প্রতিদিন তিনি তাঁহার স্বাভাবিক সাধু বৃত্তিগুলির প্রস্ফুরণের চেষ্টা করেন, নব নব সদ্‌গুণ-অর্জ্জনের জন্য তাঁহার প্রচেষ্টা রহিয়াছে। তিনি আপনার ভিতরে আপনি জাগরিত থাকিয়া অভ্যস্ত পাপগুলি প্রক্ষালন করিয়া ক্রমশঃ নির্ম্মলতর হইতে থাকেন, এবং নিজের মনকে সাধু চিন্তার দ্বারা আবৃত করিয়া পাপের আক্রমণ-পথে নিত্য-নিয়ত বাধা প্রদান করেন।

 এইরূপ কঠোর সংগ্রামের মধ্যদিয়া বৌদ্ধসাধক যে অবিদ্যাকে আংশিক পরাস্ত করিয়া সাধনার ক্ষেত্রে প্রবেশ লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই অবিদ্যার মূলোৎপাটন করিয়া বোধিলাভ করেন। এই সময়ে সাধক আপনার ক্ষুদ্র সত্তা বিশ্বসত্তার সহিত মিলাইয় দিয়া আপনার সত্যমূর্ত্তি দেখিতে পান।

 এই যে সাধনপ্রণালীর কথা বলা হইল, ইহার মধ্যে এক হিসাবে কোনো নূতনত্বই নাই। পূর্ব্ব-পূর্ব্ববর্ত্তী আচার্য্যগণ খণ্ডভাবে প্রকারান্তরে ইহা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। এই সাধনায় যেমন কঠোর তপশ্চর্য্যা নিস্ফল বলিয়া উক্ত হইল; সংযম-বন্ধনমুক্ত ভোগবিলাসও তেমনি নিন্দিত হইল। বৌদ্ধসাধন-প্রণালী প্রেমহীন শুষ্কজ্ঞান নহে; অথবা জ্ঞানহীন বিকৃত প্রেম বা ভাবোন্মাদ নহে। বৌদ্ধসাধনা যোগ ও ভোগের সামঞ্জস্য; জ্ঞান ও প্রেমের সমন্বয়। সংক্ষেপে বলিতে হইলে বলা যায়—যাহা কিছু অকল্যাণ তাহার বর্জ্জন, যাহা কিছু মঙ্গল তাহার গ্রহণ, এবং মনকে সর্ব্বপ্রকার বাধা হইতে মুক্ত করিয়া দিয়া সর্ব্বত্র ইহার পরিব্যাপ্তি; ইহাই বৌদ্ধসাধনা।

 বৌদ্ধধর্ম্ম দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেই ভিত্তি সুদৃঢ় কিনা পণ্ডিতমণ্ডলী তাহার বিচার করিতে পারেন। কিন্তু এই ধর্ম্মের শীল ও মৈত্রী মানবহৃদয়ে চির-প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। জ্ঞানরূপে এই ধর্ম্মের তত্ত্ব সাধকের হৃদয়ে যে ভাবে বিরাজ করিয়া থাকে, করুক; এই ধর্ম্মের যে অংশ সমগ্র জাতির এবং সমস্ত জীবের সেবায় ও কল্যাণ-সাধনে প্রেমের মঙ্গলমূর্ত্তি ধরিয়া বাহিরে অভিব্যক্ত হইয়া থাকে, তাহার মনোহারিত্ব অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বৌদ্ধ সাধু জগতের মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে আতপক্লিষ্টকে পাদপচ্ছায়া, তৃষিত পান্থকে পথের মধ্যস্থলে জলাশয় ও বিশ্রাম-ভবন, অসহায় রোগীকে সেবালয় এবং রোগার্ত্ত জীবকে চিকিৎসালয় দান করিয়াছেন। বৌদ্ধ সাধুদের অসামান্য স্বার্থত্যাগ সংযম, দয়া ও প্রেমের দৃষ্টান্ত পাঠকমাত্রেরই চিত্ত বিস্ময়রসে অভিষিক্ত করে, সন্দেহ নাই।

 বৌদ্ধ সাধকের চরম লাভ নির্ব্বাণ। যে সাধনপ্রণালীর মধ্য দিয়া তিনি তাঁহার লক্ষ্যে উপনীত হন, তাহা আলোচনা করিলে মনে হয়, নির্ব্বাণ বিশুদ্ধ জ্ঞানের ও বিশুদ্ধ প্রেমেরই চরম পরিণতি; ইহা নাস্তিবাচক শূন্যতা নহে। এই সাধনার নির্ব্বাণ, সমস্ত কুপ্রবৃত্তির নির্বাণ—ক্ষুদ্র আমিত্বের নির্ব্বাণ—হিংসা-দ্বেষ প্রভৃতি পাপলালসার প্রদীপ্ত শিখার চিরনির্ব্বাণ। আর এক দিক হইতে বলা যায়, নির্ব্বাণ—পাপপ্রবৃত্তির নির্ব্বাণ, প্রেমের নহে—ক্ষুদ্র সত্তার নির্ব্বাণ, বৃহৎ সত্তার নহে—অকল্যাণের নির্ব্বাণ, কল্যাণের নহে।

 নির্ব্বাণকে দার্শনিকগণ নানারূপে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন এবং তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত সমর্থন করিবার জন্য নানা যুক্তি দেখাইয়া থাকেন। নির্ব্বাণ যদি বৌদ্ধদর্শনের শূন্যতা হয়, তাহা হইলেও ইহা এক অনির্ব্বচনীয় পরম পদার্থ। সেই শূন্যতা “নাস্তি” নহে; তাহা “অস্তি” “নাস্তি” দুয়েরই অতীত, তাহা বাক্য মনের অনধিগম্য তাহা অক্ষর অপ্রমেয় ও গম্ভীর। এই শূন্যতাকে যদি পরমাত্মা, ব্রহ্ম, বিশ্বসত্তা, পূর্ণতা, Everlasting yea বা এই শ্রেণীর অন্য কোনো একটা নাম দেওয়া হয়, তাহা হইলে গুরুতর ভ্রম হয় বলিয়া মনে হয় না। যে শূন্যতা একেবারেই নাস্তি তাহা এমন কিছু লোভনীয় নহে যে ইহারই জন্য সাধক প্রাণপণ সংগ্রাম করিবেন। জ্ঞানমূলক “নেতির” দ্বারা বৌদ্ধসাধক আপনার ছোট অহংকে সংকুচিত করেন; তিনি “উস্‌সুকেসু মনুস্‌সেসু বিহরাম অনুস্‌সুক।”—আসক্ত মনুষ্যদের মাঝখানে অনাসক্তভাবে বিচরণ করেন; তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা—“জিঘচ্ছা পরমা রোগা সঙ্খারা পরমা দুখা” লোভকে পরম রোগ এবং সংস্কারকে পরম দুঃখ জানিয়া পরম সুখ নির্ব্বাণ লাভ করেন। আর একদিক দিয়া তিনি তাঁঁহার অন্তর সত্তাকে মৈত্রীভাবনাদ্বারা ভূলোকে দ্যুলোকে স্বর্লোকে পরিব্যাপ্ত করিয়া দিয়া থাকেন। বৌদ্ধসাধনা যথার্থরূপে বুঝিতে হইলে এই দুইটি দিকই ভাবিয়া দেখিতে হইবে।

 অন্তিম শয্যায় মহাপুরুষ বুদ্ধ এই সাধনার যে প্রণালী ব্যাখ্যা করিয়াছেন মহাপরিনিব্বান সুত্তে তাহা বর্ণিত আছে। ইহাতে তিনি চারিটি ধ্যান, চারিটি ধর্ম্ম-প্রচেষ্টা, চারিটি ঋদ্ধিপাদ, পাঁচটি নৈতিক বল, সাতটি বোধ ও আটটি পথ নির্দ্দেশ করিয়াছেন। তাঁঁহার প্রদর্শিত এই সাধনা বিশুদ্ধ জ্ঞান ও প্রেমেরই সাধনা। উরগবগ্‌গে মেত্তাসুত্তে সাধকের মৈত্রী ও কল্যাণ ভাবনার যে বর্ণনা রহিয়াছে তাহা অতীব চিত্তস্পর্শী। তথায় বলা হইয়াছে যে সাধক শান্তিপদ নির্ব্বাণ লাভ করিতে চাহেন; তিনি কর্ত্তব্যপালনে কুশল, সরল, বিনীত ও নিরভিমান হইবেন, তাঁহার অভাব অল্পই থাকিবে, অল্পেই তিনি সন্তুষ্ট হইবেন, তাঁহার কোন দুর্ভাবনার হেতু থাকিবে না, তিনি জিতেন্দ্রিয়, সদ্বিবেচক, অপ্রগল্ভ ও অনাসক্ত হইবেন; তিনি ক্ষুদ্র পাপও আচরণ করিবেন না, তিনি ভাবিবেন সকল জীব সুখী ও নিরাপদ্‌ হউক। তিনি ভাবিবেন, সবল দুর্ব্বল, ছোট বড়, দৃষ্ট অদৃষ্ট, দূরবর্ত্তী সমীপবর্ত্তী, ভূতকালের ভবিষ্যৎকালের সকল প্রাণী সুখী হউক। তিনি কাহাকেও বঞ্চনা করিবেন না, কাহাকেও ঘৃণা করিবেন না, অথবা ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া কাহারও অহিত চিন্তা করিবেন না; জননী যেমন নিজের আয়ু দ্বারা একমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষা করেন, তিনিও তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় প্রীতি রক্ষা করিবেন; জগতের ঊর্দ্ধে নিম্নে চতুর্দ্দিকে তিনি তাঁহার হিংসাশূন্য বৈরশূন্য বাধাশূন্য অপরিমেয় প্রীতি ব্যাপ্ত করিয়া দিবেন; দাঁড়াইতে, বসিতে, চলিতে, শুইতে, যাবৎ না নিদ্রিত হইয়া থাকেন তাবৎ, তিনি এই মৈত্রীভাবনায় নিবিষ্ট থাকিবেন। চিত্তের এই অবস্থাকেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলা হইয়াছে। বৌদ্ধশাস্ত্র ইহাকে ব্রহ্মবিহার বা সাধুজীবন আখ্যা দিয়াছেন। বৌদ্ধসাধনার শিরোভাগে এই অনির্ব্বচনীয় মৈত্রী ও মঙ্গল বিরাজিত। এই সাধনা মানবকে পরিণামে বিনাশের মধ্যে লইয়া যাইতে পারে না। পূজ্যপাদ কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় একপত্রে লিখিয়াছেন:—

 বুদ্ধদেবের আসল কথাটা কি, সেটা দেখ্‌তে গেলে তাঁর শিক্ষার মধ্যে যে অংশটা নিগেটিভ্‌ সেদিকে দৃষ্টি দিলে চলবে না, যে অংশ পজিটিভ্‌ সেইখানে তাঁর আসল পরিচয়। যদি দুঃখ দূরই আসল কথা হয়, তাহলে বাসনালোপের দ্বারা অস্তিত্ব লোপ করে দিলেই সংক্ষেপে কাজ শেষ হয়; কিন্তু মৈত্রীভাবনা কেন? এর থেকে বোঝা যায় যে ভালবাসার দিকেই আসল লক্ষ্য। আমাদের অহং আমাদের ভালবাসা স্বার্থের দিকে টানে, বিশুদ্ধ প্রেমের দিকে আনন্দের দিকে নয়। এইজন্য অহংকে লোপ করে দিলেই সহজে সেই আনন্দলোক পাওয়া যাবে। “পূর্ণিমা” বলে “চিত্রায়” একটা কবিতা আছে; তাতে আছে একদিন সন্ধ্যার সময়ে নৌকায় ব’সে সৌন্দর্য্যতত্ত্বসম্বন্ধে একটি বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে যাই বাতি নিবিয়ে দিলুম অমনি নৌকার সমস্ত জানলা দিয়ে জ্যোৎস্নার ধারা এসে আমার কক্ষ প্লাবিত করে দিলে। ঐ ছোট বাতি আমার টেবিলে জ্বল্‌ছিল বলে আকাশভরা জ্যোৎস্না ঘরে প্রবেশ করতেই পারে নি। বাহিরে যে এত অজস্র সৌন্দর্য্য ভূলোক দ্যুলোক আচ্ছন্ন করে অপেক্ষা করছিল তা আমি জানতেও পারি নি। অহং আমাদের সেই রকম জিনিষ; অত্যন্ত কাছের এই জিনিষটা আমাদের বোধশক্তিকে চারিদিক থেকে এমনি আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে অনন্ত আকাশভরা অজস্র আনন্দ আমরা বোধ করিতেই পারি নাই। এই অহংটুকু যেদিন নির্ব্বাণ হবে অমনি অনির্ব্বচনীয় আনন্দ এক মুহূর্ত্তে আমাদের কাছে পরিপূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ হবেন। সেই আনন্দই যে বুদ্ধের লক্ষ্য তা’ বোঝা যায় যখন দেখি তিনি লোকলোকান্তরের জীবের প্রতি মৈত্রীবিস্তার করতে বল্‌চেন। এই জগদ্ব্যাপী প্রেমকে সত্যরূপে লাভ করতে গেলে নিজের অহংকে নির্ব্বাপিত করতে হয়, এই শিক্ষা দিতেই বুদ্ধদেব অবতীর্ণ হইয়াছিলেন; নইলে মানুষ বিশুদ্ধ আত্মহত্যার তত্ত্বকথা শোনবার জন্য তাঁর চারদিকে ভিড় করে আস্‌ত না।

 মহাবগ্‌গে ষষ্ঠখণ্ডে লিচ্ছবি-সেনা-নায়ক নিগ্রন্থ সাধু সিংহের সহিত মহাপুরুষ বুদ্ধদেবের একটি আলোচনা বিস্তারিত বর্ণিত আছে। সেই প্রসঙ্গে বুদ্ধ তাঁহার সাধনার দুইদিকই সুস্পষ্টভাবে দেখাইয়া দিয়াছেন। অতি সংক্ষেপে তাহার সারমর্ম্ম এই—হে সিংহ, আমি ক্রিয়াবাদ অস্বীকার করি ইহা সত্য, কারণ আমি শিক্ষা দিয়া থাকি কোনো সাধক যেন বাক্যে, কার্য্যে বা চিন্তায় এমন কোনে ক্রিয়া করেন না যাহা অকল্যাণকর কিংবা যাহা মনে অকল্যাণ ভাব জন্মাইয় দেয়।

 হে সিংহ, আমি ক্রিয়াবাদ স্বীকার করি ইহাও সত্য কারণ আমি শিক্ষা দিয়া থাকি সাধক যেন বাক্যে কার্য্যে বা চিন্তায় এমন ক্রিয়াই করেন যাহা কল্যাণকর কিংবা যাহা মনে কল্যাণের ভাব জন্মাইয়া দেয়।

 হে সিংহ, আমি উচ্ছেদবাদ ঘোষণা করি ইহা সত্য; কারণ আমি অহংকার কামাভিলাষ কু-ভাবনা ও ভ্রান্তির উচ্ছেদ ঘোষণা করি। কিন্তু আমি ক্ষমা প্রেম দাক্ষিণ্য ও সত্যের উচ্ছেদ ঘোষণা করি না।

 হে সিংহ আমি বাক্যে কার্য্যে ও চিন্তায় অধর্ম্মাচরণ জুগুপ্সিত বা ঘৃণিত বলিয়া মনে করি।

 হে সিংহ, আমি অহংকার, কামাভিলাষ, কুভাবনা ও ভ্রান্তির বিনয় অর্থাৎ অপনয়ন ঘোষণা করি; কল্যাণভাবের অপনয়ন ঘোষণা করি না।

 হে সিংহ, আমি হৃদয়ের অকল্যাণভাবের তপ অর্থাৎ দাহন ঘোষণা করি, কল্যাণভাবের দাহন ঘোষণা করি না।

 বুদ্ধের উল্লিখিত উক্তি হইতে আমরা স্পষ্টই বুঝিতে পারি যে বৌদ্ধ-সাধনা, বিশুদ্ধ আত্মহত্যার সাধনা নহে। বৌদ্ধসাধক আপনার অহংকার কামাভিলাষ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া যে শান্তিপ্রদ নির্ব্বাণ লাভ করেন, সেই অবস্থাটিই সাধনার সর্ব্বোচ্চ অবস্থা কি না জোর করিয়া তাহা বলা চলে না। অধ্যাত্মতত্ত্ব-সম্বন্ধে বুদ্ধের নিস্তব্ধতা আলোচনা করিয়া কেহ কেহ মনে করেন, যে মানববুদ্ধি আধ্যাত্মিকতার যে উচ্চতম অবস্থা কল্পনা করিতে পারে, তাহার বাহিরে অতি উচ্চতম অবস্থাও আছে ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। বুদ্ধের অনন্ত-প্রসারী আধ্যাত্মিক দৃষ্টি নির্ব্বাণের সীমাহীন আকাশ ভেদ করিয়া পরপারে উত্তীর্ণ হইয়াছিল, তাঁহার নিস্তব্ধতাই ইহার একটি প্রমাণ। তিনি তাঁহার অনুগত ভক্ত ও সাধারণ লোকের দৃষ্টির সম্মুখে শান্তি ও কল্যাণের আকর নির্ব্বাণ-লোক উপস্থাপিত করিয়া সন্তুষ্ট ছিলেন; সে লোক অতিক্রম করিয়া কোন্‌ লোক রহিয়াছে তাহা বলেন নাই।

 বুদ্ধের এই নির্ব্বাণ সাধনার একটি চমৎকার বিশেষত্ব আছে। তিনি সাধকের সম্মুখে একটি সুনির্দ্দিষ্ট পথ চিত্রিত করিয়া দিয়াছেন, সাধক এই পথে একমাত্র আত্মশক্তির উপর নির্ভর করিয়া চলিবেন বটে, কিন্তু তাঁহাকে কোথাও অনিশ্চিতত্বের মধ্যে পড়িয়া ঘুরিয়া মরিতে হইবে না। সাধকের চলিবার বলিবার ভাবিবার ধ্যান করিবার মনন করিবার, সময় বিষয়গুলি সুনির্দ্দিষ্ট এবং ধারাবাহিকরূপে সুবিন্যস্ত। কল্যাণপথগামী সাধককে যতখানি ইঙ্গিত করিলে তিনি তাঁহার লক্ষ্যস্থানে উত্তীর্ণ হইতে পারেন তিনি তাঁহাকে ততখানিই ইঙ্গিতে জানাইয়াছেন। রোগীকে তিনি ঔষধ দিয়াছেন, হয়ত অনাবশ্যক বোধে তাহাকে তাহার ব্যাধির মূলকারণটি বলেন নাই। জিজ্ঞাসিত হইয়াও বুদ্ধদেব অনেক দুর্জ্ঞেয় তত্ত্বের রহস্যসম্বন্ধে নিরুত্তর ছিলেন; তাঁহার সেই নিস্তব্ধতা নিন্দুকদলের আক্রমণের একটি বিষয় হইয়াছে সন্দেহ নাই। তা’ বলিয়া এই সাধনার চরমলক্ষ্যকে কোনোক্রমে পরিমিত বলা চলে না। নিরবশেষ আত্মত্যাগ করিয়া যে লাভ তাহাই পরম লাভ। সুতরাং বৌদ্ধসাধক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া পরম শ্রেয়ো লাভ করেন, ইহা ধ্রুব নিশ্চিত।