পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৫
মাঝির ছেলে

 নাগার সাড়াশব্দ না পেয়ে হারু মাঝি নিজেই ভাত খেতে বাড়ি গেল। অন্যদিন ফিরতে তার দেরি হয়, আজ খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল।

 ‘যা, খা গিয়া নাগা।’

 নাগা নৌকা থেকে নেমে গেল।

 ‘আমি আর আসুম না।’

 ‘আইচ্ছা। ভোরে আসিস্‌।’

 কোনদিন হারু মাঝি নৌকায় ঘুমায়, কোনদিন নাগা ঘুমায়। বাড়ির চেয়ে নৌকায় মশা কম লাগে। গ্রামের মাঝামাঝি হারু মাঝির বাড়ি, নদী থেকে বেশী দূর নয়। গ্রামের প্রায় সমস্ত আলোই নিভে গেছে, তেল পুড়িয়ে গ্রামের লোক রাত জাগে না। আধখানা চাঁদের আলো দুঃখী মানুষের হাসির মত ছড়িয়ে আছে। এর চেয়ে অন্ধকার নাগার ভাল লাগে। মেটে রাস্তার ধারে দু’খানা ঘর নিয়ে হারু মাঝির বাড়ি, পিছনে বাঁশ ঝাড়, ডাইনে মস্ত একটা ডোবা আর বাঁয়ে নকুল সাহার টিনের বাড়ি। অন্যদিন রাত হলে সকলে ঘুমিয়ে থাকে, রান্নার যা অবশিষ্ট থাকে নাগা নিজেই গিয়ে খায়। আজ হারু মাঝির বৌ আর মেয়ে নাগার জন্যই জেগে বসে ছিল। হারু মাঝি বোধ হয় বলে গেছে।

 ‘রাইত করলি যে নাগা? রামতলায় গেছিলি, না? বয়, ভাত খা। অ কালী, দে দাদারে একখান পিঁড়া পাইতা দে।’

 এরকম সাদর অভ্যর্থনা নতুন। নাগার মন আরও খারাপ হয়ে গেল। তার চাকরির কথা জানা মাত্র সবাই তাকে খাতির করতে আরম্ভ করেছে! দু’দিন অপেক্ষা করেই না হয় খাতিরটা আরম্ভ করত, দু’দিন পরেই না হয় জানিয়ে দিত, এতকাল তুমি মর বাঁচ আমাদের বয়ে গেছিল, আজ তুমি বড় চাকুরে তাই তোমাকে আদর যত্ন করছি।

 কালী চুপি চুপি বলল, ‘বাবা তোমার লাইগা দুই আনা পয়সা রাইখা গেছে দাদা।’

 নাগার ইচ্ছা হতে লাগল, ছুটে পালিয়ে যায়। চাটায়ে শুয়ে সে এই সব কথাই ভাবতে লাগল। নিজের টুকিটাকি জিনিস কয়েকটি নিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, এটা সে আগেই ঠিক করেছিল।