পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৯
মাঝির ছেলে

 আটখামারের ঘাট এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে, এখানে এখনো চারিদিক সরগরম। এখনো বাইরে থেকে নৌকা এসে নৌকার ভিড়ে নাক গুজে দিচ্ছে, লঞ্চ ও স্টীমারের তীক্ষ্ণ বাঁশির বিরাম নেই। মাল নামানো আর বোঝাই দেওয়ায় ঠেলা পড়লেও এখনো শেষ হয়নি। তীরের দোকানপাট এখনো খোলা, মানুষের কেনা-বেচার খেলায় রাত্রির ছেদ পড়েনি। লঞ্চ থেকে চোখে পড়ে, বড় একটা গুদামঘরের পাশে তাঁবু খাটানো হয়েছে, সামনে জ্বলছে তিন চারটা ডে-লাইট। আর ভিড় করে দাড়িয়ে মানুষ বেসুরা কনসার্টের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনছে। ভিতরে কি খেলা দেখাচ্ছে কে জানে।

 ‘কত লোক নদীর বুকে জীবন কাটায় দেখছস নাগা? আমারো মন করে জলে ভাইসা দিনরাত কাটাইয়া দেই। লঞ্চ কিনছি কি সাধে?

 নদীর বুকে দিনরাত কাটানোর জন্য যাদববাবু লঞ্চ কিনেছেন? কিন্তু সে সাধতো নৌকাতে ভেসে বেড়িয়েই মেটানো চলত?

 ‘জানস্ নাগা, মাঝিগো মতন সুখী মানুষ জগতে নাই।”

 ‘মাঝিরা বড় গরীব কর্তা।”

 বাদববাবু যেন ধাক্কা খেয়ে পাক দিয়ে ঘুরে দাঁড়ান, ক্রুদ্ধ চাপা গলায় বলেন, “আমি গরীব না? সর্বস্ব দিয়া লঞ্চ কিনি নাই আমি? দাদা আজ ভিন্ন হইয়া গেলে এই লঞ্চ বাদে আমার কাণাকড়ি সম্বল থাকবে না। জানস? মাঝিরা গরীব, আমি য্যান মস্ত বড়লোক! বলদের মত কথা কস ক্যান?”

 যাদববাবুকে সে কখন বড়লোক বলেছে, মাঝিরা গরীব বলে তার বড়লোক হতে আপত্তি কিসের আর বড়লোক বললেও তাঁর ফোঁস করে উঠবার কি আছে, এসব নাগা কিছুই ভেবে পায় না। তাই সে চুপ করে থাকে। কিন্তু মানুষটাকে হঠাৎ যেন তার বেশীরকম আপন জন বলে মনে হয়, যাদববাবুও যেন সত্যিই মাঝি, লেখাপড়া জানা জুতোজামা পরা ভদ্রলোক মাঝি।

 সকালে নিতাই সাহার জন্যে অপেক্ষা না করে যাদববাবু নিজেই তার