পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫১
মাঝির ছেলে

মাল বোঝাই হচ্ছে নিতাই সাহার। খোঁজ পাওয়া গেল সহজেইণ মস্ত একটা গাধাবোট আর পানসিতে মাল বোঝাই হচ্ছে। লোহার ফিতায় টাইট করে বাধা চটে মোড়া লম্বাটে চারকোণা গাটে গাধাবোটটি প্রায় ভরে গেছে, কয়েকটার বেশী আর বোঝাই দেওয়া চলবে না। পানসিতে সবে বোঝাই দিতে আরম্ভ করা হয়েছে মুখবান্ধা পেটমোটা বস্তা। ছোট একটি লঞ্চ গাধাবোটটি টেনে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। রঙ-চটা, অপরিচ্ছন্ন খাপছাড়া গড়নের লঞ্চ—যাদববাবুর লঞ্চের কাছে যেন ভদ্রলোকের কাছে ছোটলোক।

 “চালান কই যাইবো মাঝি?”

 মাঝিদের মধ্যে আলাপ আরম্ভ করতে পরিচয় দরকার হয় না, ভূমিকা দরকার হয় না, ছুতাও দরকার হয় না। জীবনে কখুনো পরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখেনি এমন দু’জন মাঝি যখন কথা বলতে আরম্ভ করে, মনে হয় তাদের বুঝি বহুদিনের ঘনিষ্ঠতা।

 “যাইবো গোয়ালন্দ। নিতাই সা’র মাল।”

 ‘তামুক পাতা না?”

 'হ।'

 ঘর্মাক্ত কলেবরে ডাঙ্গায় উবু হয়ে বসে গাধাবোটের মাঝি তামাক টানে আর লঞ্চ ও গাধাবোটের দিকে তাকিয়ে রাগে নাগার গা জ্বলে য়ায়। একি অন্যায় নিতাই সাহার। লঞ্চ সে ভাড়া করল। কিন্তু যাদববাবুর লঞ্চটা ভাড়া করল না।

 তারপর নাগার দৃষ্টি পড়ে আরেকজন মানুষের দিকে। পাঠেই একটি জেটি, তার শেষ প্রান্তে কুর্ত গায়ে একটি লোক গাধাবোঁটের মাঝির মত উবু হয়ে বসে সাদা রুমাল নাড়ছে। তার অন্য হাতে জ্বলছে একটা সিগারেট। রুমাল না নাড়লে হয়তো লোকটির দিকে নাগার নুজির পড়ত না, মনেও হত না যে লোকটি যেন তার চেনা। চেনা-চেনা লোকটি এভাবে হাত উচু করে রুমাল নাড়ছে কেন ভেবে নাগা সবে আশ্চর্য হতে আরম্ভ করেছে, রুমালটা কুর্তার পকেটে ভরে সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে সে আকাশের দিকে মুখ করে ধোয়া ছাড়ল।