পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাঝির ছেলে
৪৪

 নাগা শোনে আর ভাবে। কোণাকুণি এগিয়ে যখন মাঝ-নদীতে ছোট একটি স্টীম লঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছয় তখন সে মুখ খোলে।

 ‘-ঠিক কইছেন কর্তা, গরীব বইলাই আমি গোঁয়ার।’

 নাগা ভেবেছিল যাদববাবুর লঞ্চ-জাহাজ বুঝি নতুন ধরনের কিছু হবে কিন্তু বাইরে থেকে কোন নতুনত্বই তার চোখে পড়ল না। এ রকম লঞ্চ-জাহাজ সে অনেক দেখেছে। তারা সকলে লঞ্চে উঠবার পর ডিঙ্গিটিকেও কপি-কল দিয়ে তুলে নেওয়া হল।

 হাফসার্ট গায়ে পেণ্টলুন পরা বেঁটে কালো একটি লোক খালাসীদের হুকুম দিচ্ছিল, এবার সামনে এসে যাদববাবুর কাছে হুকুম চাইল, ‘চালাই?”

 লোকটির গলার আওয়াজ মিষ্টি আর চাপা, যেন ভয়ে ভয়ের কথা বলছে কিন্তু মুখ দেখলে মনে হয় সে যেন মুখভঙ্গি করছে ভয় দেখাবার জন্য। মুখের গড়নে যে কোন রকম বিকৃতি আছে তা নয়, তবু রাগের সময় দাঁতে দাঁত ঘষলে মানুষের মুখের চেহারা যেমন হয় তার মুখখানাও অনেকটা সেই রকম।

 যাদববাবু বললেন, ‘হ চালাও। ফুল স্পীড চাই, ভিমনা, দেরি হয়ে গেছে।’

 নাগার দিকে না তাকিয়েই ভিমনা চলে গেল।

 নাগা জিজ্ঞাসা করল, ‘কে কর্তা মানুষটা?’

 ‘আমার জাহাজের সারেঙ্গ।’

 ‘বদমেজাজী মানুষ সন্দ করি কর্তা।’

 উঁহু, অমান ঠাণ্ডা মানুষ আর হয় না। রাগ নেই, হিংসা নেই, বড় ভালো মানুষ।’

 নাগা নোঙর ফেলে নি, ইঞ্জিনও বন্ধ ছিল না, স্রোতের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে চাকা ঘুরিয়ে লঞ্চটিকে একরকম স্থির করে রাখাই হয়েছিল এতক্ষণ। এবার ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়ার সঙ্গে লঞ্চের গতিও বাড়তে লাগল, চক্রাকারে পাক দিয়ে দিক পরিবর্তন করে লঞ্চ এগিয়ে চলল। গতিবেগ ক্রমেই বাড়তে লাগল আর সার্চ লাইটের তীব্র দৃষ্টি মেলে লঞ্চটাই যেন পথ খুঁজে নিতে লাগল।