কর্ম্মফল/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


ষোড়শ পরিচ্ছদ।

 শশধর। সতীশ একটু ঠাণ্ডা হও! তোমার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় হয়েচে সে কি আমি জানিনে? তোমার মাসী রাগের মুখে কি বলেচেন সে কি অমন করে মনে নিতে আছে? দেখ, গোড়ায় যা ভুল হয়েচে তা এখন যতটা সম্ভব প্রতিকার করা যাবে তুমি নিশ্চিন্ত থাক!

 সতীশ। মেসোমশায়, প্রতিকারের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। মাসীমার সঙ্গে আমার এখন যেরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েচে তাতে তোমার ঘরের অন্ন আমার গলা দিয়ে আর গলবে না। এতদিন তোমাদের যা খরচ করিয়েচি তা যদি শেষ কড়িটি পর্য্যন্ত শোধ করে না দিতে পারি তবে আমার মরেও শান্তি নাই। প্রতিকার বাদ কিছু থাকে ত সে আমার হাতে, তুমি কি প্রতিকার করবে?  শশধর। না, শোন সতীশ—একটু স্থির হও! তোমার যা কর্ত্তব্য সে তুমি পরে ভেবো—তোমার সম্বন্ধে আমরা যে অন্যায় করেচি তার প্রায়শ্চিত্ত ত আমাকেই করতে হবে। দেখ, আমার বিষয়ের এক অংশ আমি তোমাকে লিখে দেব—সেটাকে তুমি দান মনে করো না, সে তোমার প্রাপ্য। আমি সমস্ত ঠিক করে রেখেচি—পর্শু শুক্রবারে রেজেষ্ট্রি করে দেব।

 সতীশ। (শশধরের পায়ের ধূলা লইয়া) মেসোমসায়, কি আর বলব—তোমার এই স্নেহে—

 শশধর। আচ্ছা থাক্ থাক্‌! ও সব স্নেহ ফ্নেহ আমি কিছু বুঝিনে, রসকস আমার কিছুই নেই—যা কর্ত্তব্য তা কোনো রকমে পালন কর্ত্তেই হবে এই বুঝি। সাড়ে আটটা বাজল, তুমি আজ কোরিন্থিয়ানে যাবে বলেছিলে যাও! সতীশ একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। দানপত্রখানা আমি মিষ্টার ভাদুড়িকে দিয়েই লিখিয়ে নিয়েচি। ভাবে বোধ হল তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন—তোমার প্রতি যে তার টান নেই এমন ত দেখা গেল না। এমন কি, আমি চলে আসবার

সময় তিনি আমাকে বল্লেন সতীশ আজকাল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে না কেন?
(সতীশের প্রস্থান)

 ওরে রামচরণ, তোর মা ঠাকুরাণীকে একবার ডেকে দে ত!

সুকুমারীর প্রবেশ।

 সুকুমারী। কি স্থির করলে?

 শশধর। একটা চমৎকার প্ল্যান ঠাউরেচি!

 সুকুমারী। তোমার প্ল্যান যত চমৎকার হবে সে আমি জানি। যাহোক সতীশকে এ বাড়ি হতে বিদায় করেচ ত?

 শশধর। তাই যদি না করব তবে আর প্ল্যান কিসের? আমি ঠিক করেচি সতীশকে আমাদের তরফ মাণিকপুর লিখে পড়ে দেব—তা হলেই সে স্বচ্ছন্দে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।

 মুকুমারী। আহা কি সুন্দর প্ল্যানই ঠাউরেচ। সৌন্দর্য্যে আমি একেবারে মুগ্ধ! না, তুমি অমন পাগলামি করতে পারবে না আমি বলে দিলেম।  শশধর। দেখ, এক সময়ে ত ওকেই সমস্ত সম্পত্তি দেবার কথা ছিল।

 সুকুমারী। তখন ত আমার হরেন জন্মায়নি। তা ছাড়া তুমি কি ভাব তোমার আর ছেলেপুলে হবে না!

 শশধর। সুকু, ভেবে দেখ আমাদের অন্যায় হচ্ছে। মনেই করনা কেন তোমার দুই ছেলে।

 মুকুমারী। সে আমি অতশত বুঝিনে—তুমি যদি এমন কাজ কর তবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব—এই আমি বলে গেলেম।

(সুকুমারীর প্রস্থান)

সতীশের প্রবেশ।

 শশধর। কি সতীশ থিয়েটারে গেলে না?

 সতীশ। না মেসোমশায়, আজ আর থিয়েটার না। এই দেখ দীর্ঘকাল পরে মিষ্টার ভাদুড়ির কাছ হতে আমি নিমন্ত্রণ পেয়েচি! তোমার দানপত্রের ফল দেখ! সংসারের উপর আমার ধিক্কার জন্মে গেছে মেসোমশায়! আমি তোমার সে তালুক নেব না!

 শশধর। কেন সতীশ?  সতীশ। আমি ছদ্মবেশে পৃথিবীর কোনো সুখভোগ করব না। আমার যদি নিজের কোন মূল্য থাকে, তবে সেই মূল্য দিয়ে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই ভোগ করব, তার চেয়ে এক কানা কড়িও আমি বেশি চাই না। তাছাড়া, তুমি যে আমাকে তোমার সম্পত্তির অংশ দিতে চাও মাসীমার সম্মতি নিযেচ ত!

 শশধর। না সে তিনি—অর্থাৎ সে একরকম করে’ হবে। হঠাৎ তিনি রাজি না হতে পারেন, কিন্তু—

 সতীশ। তুমি তাঁকে বলেছ?

 শশধর। হাঁ, বলেছি বইকি! বিলক্ষণ! তাঁকে না বলেই কি আর—

 সতীশ। তিনি রাজি হয়েছেন?

 শশধর। তাকে ঠিক রাজি বলা যায় না বটে, কিন্তু ভাল করে বুঝিয়ে—

 সতীশ। বৃথা চেষ্টা মেসোমশায়। তাঁর নারাজিতে তোমার সম্পত্তি আমি নিতে চাইনে। তুমি তাঁকে বলে আজ পর্য্যন্ত তিনি আমাকে যে অন্ন খাইয়েচেন তা উদগার না করে আমি বাঁচব না! তাঁর সমস্ত ঋণ সুদসুদ্ধ শোধ করে তবে আমি হাঁফ ছাড়ব।

 শশধর। সে কিছুই দরকার নেই সতীশ— তোমাকে বরঞ্চ কিছু নগদ টাকা গোপনে—

 সতীশ। না মেসোমশায় আর ঋণ বাড়বেনা। তামার কাছে এখন কেবল আমার একটি অনুরোধ আছে। তোমার যে সাহেব-বন্ধুর আপিসে আমাকে কাজ দিতে চেয়েছিলে, সেখানে আমার কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।

 শশধর। পারবে ত!

 সতীশ। এর পরেও যদি না পারি তবে পুনর্ব্বার মাসীমার অন্ন খাওয়াই আমার উপযুক্ত শাস্তি হবে!