পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আজ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে কেন্দ্র করিয়াই আমার কথা। আমার সমতিতে আসীন আচার্যদেব বালপ্রকৃতি, মধরভাষী, শীর্ণদেহ, জ্ঞানতপস্বী, দেশপ্রেমিক এবং ত্যাগের মহিমায় সমন্জেল। আজও পষ্ট মনে পড়ে সেই পয়তাল্লিশ বৎসর পবেকার কথা যেদিন তাঁহার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে গরশিষ্যের সেই পরিচয় দিনের পর দিন ঘনীভূত নিবিড়তর ও সাথক হইয়াছে। স্নেহমন্ধ মনে আজ সেই সকল দিনগুলি স্মরণ করিতেছি। তাঁহার ক্লাশে যখনই শিক্ষালাভ করিতে যাইতাম অনুভব করিতাম চারিদিকে নতুন হাওয়া বহিতেছে। শিশর মতন খেলা মন লইয়া গরদেব আমাদের সকলকেই অতি আপনার জন করিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার কাছে জিজ্ঞাসা করিবার, আলাপ-আলোচনা করিবার, তক করিবার, জানিয়া লইবার অবাধ স্বাধীনতা আমাদের ছিল। তিনি প্রণম্য, তিনি প্রাচীন, অসীম তাঁহার জ্ঞান কিন্তু তিনি আমাদের অতি নিকট বন্ধসম ছিলেন। তাঁহার মধর হাসি– তাঁহার অকপট ব্যবহার তাঁহার নিরাড়ম্বর বাসগৃহ, তাঁহার শচিসিনাধ বেশ, তাঁহার নিরলস, কমব্যস্ত জীবন, তাঁহার উৎসাহ যেন জাদুমন্ত্র বলে আমাদের জীবনধারাকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। তাঁহার অপরিমিত নেহের প্রভাবে ও সত্যুদস্টিতে এবং পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদানে আমরা আমাদের ভাবী জীবনপথের সিগন্যাল দেখিতে পাইয়াছিলাম। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁহার বড় দঃখ ছিল। তিনি বলিতেন পরীক্ষকের পেন্সিল মাকার মনদণ্ডে এই শিক্ষার পরিমাপ হয়। তাই কোনও প্রকার গবেষণার রসধারায় আমাদের মানসক্ষেত্র উবর হয় না। অন্যান্য দেশের সহিত তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রভেদ লজ্জাজনক। মানষের সকল শিক্ষার মলে আছে সংযমের সাধনা। আচার্যদেব নিয়মকে সম্পর্ণেরপে জানিয়া এবং মানিয়া চলিতেন। সেই জন্যই তাঁহার চিররান দেহ তাঁহার কাজের অন্তরায় হয় নাই। নষ্ট বাস্থ্য ফিরিয়া পাওয়ার অজহাতে অলসভাবে দিনাতিপাত তিনি করেন নাই। আত্মশাসনব্লতে নিজেকে কঠোরভাবে নিয়োগ করিয়া বছরের পর বছর এই শীর্ণদেহখানিকে অপরিবতিত রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এক অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন কমযোগীরপে তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। জীবনকে ধরাবাঁধা একটা প্রাত্যহিক ছকের মধ্যে আনিয়া তিনি যে কম বহল জীবন যাপন করিয়া গিয়াছেন তাহা অতীব বিস্ময়কর। এক বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক তাঁহার সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন “ভারতের মন্তি হয়তো প্রফুল্লচন্দ্রের জীবদ্দশায় হবে না—এই ক্ষীণকায় মানুষটির জীবন দেশের কাজে নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু অমর হয়ে থাকবে তাঁর ত্যাগের দান।”