পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৭

একজন নির্বোধকেই সৃষ্টি করা হয়।” কিন্তু হিন্দুদের এবং ততোধিক মুসলমানদের মধ্যে উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় পৈতৃক সম্পত্তি অসংখ্য সমান অংশে বিভক্ত হয় এবং তাহার ফলে অসংখ্য মূঢ়, নির্বোধ এবং উচ্ছৃঙ্খলের আবির্ভাবের পথ প্রস্তুত হয়।

 যাঁহারা ইউরোপীয়দের গদীর বেনিয়ান ছিলেন, অথবা যাঁহারা ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা যে পরিশ্রমী, কর্মঠ, উদ্যোগী ও সহিষ্ণু মাড়বার, যোধপর ও বিকানীরের অধিবাসীদের দ্বারা ক্রমে ক্রমে বাণিজ্যক্ষেত্র হইতে বহিষ্কৃত হইবে, ইহা স্বাভাবিক। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের সময়েই বড়বাজারের অনেক অংশ তাহাদের হাতে যাইয়া পড়ে। কিন্তু তখনও কতকগুলি বড় বড় বাঙ্গালী ব্যবসায়ী ছিল, যাহাদের পূর্বপুরুষরা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সহিত কারবার করিয়াছিলেন।

 কিন্তু সুয়েজ খাল খোলার পর হইতে প্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ক্ষেত্রে যুগান্তর উপস্থিত হইল। ইহার ফল কিরূপ হইয়াছে, তাহা কলিকাতার ১৮৭০ সালের আমদানী রপ্তানীর হিসাবের সঙ্গে ১৯২৭—২৮ সালের হিসাবের তুলনা করিলেই বুঝা যায়।[১] লণ্ডন, লিভারপুল এবং গ্লাসগো বোম্বাই ও কলিকাতার নিকটতর হইল। আর রেলওয়ের দ্রুত বিস্তৃতি ও তাহার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরের ষ্টিমার সার্ভিস—সেই নৈকট্য আরও বৃদ্ধি করিল। বড়বাজার ও ক্লাইভ ষ্ট্রীট এখন মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া ব্যবসায়ীতে পূর্ণ এবং বাঙ্গালীরা বলিতে গেলে স্বেচ্ছাক্রমেই বাণিজ্যজগত হইতে সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত হইয়াছে। বড়বাজারের দক্ষিণ অংশের যেখানে রয়েল এক্সচেঞ্জ, ব্যাঙ্ক ও শেয়ার বাজার আছে, সেখানে ইউরোপীয় বণিকদের প্রাধান্য, কিন্তু সেখানে প্রত্যহ যে কোটি কোটি টাকার কারবার চলিতেছে তাহার সঙ্গে মাড়োয়ারী ও ভাটিয়াদের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এই অঞ্চলের, তথা বড়বাজারের জমির স্বত্ব পর্যন্ত বাঙ্গালীদের হাত হইতে চলিয়া গিয়াছে। অভাবে পড়িয়াই বাঙ্গালীকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রয় করিতে হইয়াছে। একটা জাতির জীবনে যে দুর্ল্লভ সুযোগ আসে, তাহা এইভাবে কাড়িয়া লইতে দেওয়া হইল। বাংলা তাহার সুযোগ চিরকালের জন্য হারাইয়াছে। তাহার প্রাচীন অভিজাত বংশের বংশধরগণ এবং ভদ্রলোক সম্প্রদায় তাহাদের নিজের জন্মভূমিতেই গৃহহীন ভবঘুরে হইয়া দাঁড়াইয়াছে; তাহারা হয় অনশনে আছে, অথবা সামান্য বেতনে কেরাণীগিরি করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেছে।

 এখন আমার নিজের কথা বলি। আমার সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাইনর ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা পাশ করাতে, তাঁহাকে শিক্ষা শেষ করিবার জন্য কলিকাতায় আসিতে হইল। আমার অগ্রজ এবং আমি এম, ই, পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। আমার পিতার পক্ষে এখন একটা গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হইল। তিনি সাধারণ পল্লীবাসী ভদ্রলোকের চেয়ে বেশী শিক্ষিত ছিলেন এবং কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি উত্তমরূপে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার ছেলেরাও যাহাতে তৎকালীন উচ্চতম শিক্ষা পায়, এজন্য তিনি ব্যগ্র ছিলেন।


  1. কলিকাতার বন্দরে মোট আমদানী পণ্যজাতের মূল্য (গবর্নমেণ্ট ষ্টোর্স ব্যতীত):—
    টাকা টাকা
    ১৮৭০-৭১ ১৬,৯৩,৯৮,১৮০ ১৯২৭-২৮ ৮৩,৫৯,২৪,৭৩৪

    কলিকাতার বন্দর হইতে মোট রপ্তানী পণ্যজাতের মূল্য (গবর্ণমেণ্ট ষ্টোর্স ব্যতীত):—

    ২২,৫৭,৮২,৯৩৫১৮৭০-৭১ ১৩৭,৬৭,৩৮,৭৭৯১৯২৭-২৮
    ভারতীয় পণ্যদ্রব্য ২২,৫৭,৮২,৯৩৫ ১৩৭,৬৭,৩৮,৭৭৯
    বিদেশী পণ্যদ্রব্য ২৯,৩৮,৫৫৩ ৭০,৯৫,৮২২
    ——————— ————————
    বিদেশী পণ্যদ্রব্যমোট— ২২,৭৭,২১,৪৮৮ ১৩৮,৩৮,৩৪,৬০১

    উহা হইতে দেখা যাইবে যে, আমদানী ও রপ্তানী পণ্যদ্রব্যের মূল্য প্রায় ছয় গুণ বাড়িয়াছে।