পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
২৩

মাত্র ১২ বৎসর সেই সময় আমি শেষরাত্রে ৩টা, ৪টার সময় উঠিয়া কোন প্রিয় গ্রন্থকারের বই নির্জনে বসিয়া পড়িতাম। পরে আমি এই অভ্যাস ত্যাগ করি; কেননা, ইহাতে স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত হয়, লাভও বিশেষ কিছু হয় না। এখন পর্যন্ত ইতিহাস ও জীবনচরিত আমার খুব প্রিয় জিনিষ। চেম্বারের জীবনচরিত আমি কয়েকবার আগাগোড়া পড়িয়াছি, নিউটন ও গ্যালিলিওর জীবনী আমার বড় ভাল লাগিত, যদিও সে সময়ে জ্ঞান-ভাণ্ডারে তাঁহাদের দানের মহিমা আমি বুঝিতে পারিতাম না। সার উইলিয়াম জোন্স, জন লেডেন এবং তাঁহাদের ভাষাতত্ত্বের অগাধ জ্ঞান আমার মনকে প্রভাবান্বিত করিত। ফ্রাঙ্কলিনের জীবনীও আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। জোন্সের প্রশ্নের উত্তরে তাঁহার মাতার সেই উক্তি— ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’—আমি ভুলি নাই। আমার বাল্যকাল হইতেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আমাকে খুব আকৃষ্ট করিতেন এবং ১৯০৫ সালে আমি যখন দ্বিতীয়বার ইংলণ্ডে যাই, সেই সময় তাঁহার একখানি ‘আত্মচরিত’ সংগ্রহ করিয়া বহুবার পাঠ করি। পেন্সিলভেনিয়া প্রদেশের এই মহৎ ব্যক্তির জীবনী চিরদিনই আমার নিকট আদর্শ স্বরূপ ছিল— কিরূপে সামান্য বেতনের একজন কম্পোজিটার হইতে তিনি নিজের অদম্য অধ্যবসায় ও দুর্জয় শক্তির দ্বারা দেশের একজন প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইয়াছিলেন, তাহা আমি সবিস্ময়ে স্মরণ করিতাম।

ব্রাহ্ম সমাজ

 কতকটা আশ্চর্যের বিষয় হইলেও, বাল্যকাল হইতেই আমি ব্রাহ্মসমাজের দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। নানা কারণে ইহা ঘটিয়াছিল। আমার পিতা বাহ্যতঃ প্রচলিত হিন্দুধর্মে নামমাত্র বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু অন্তরে পূর্ণরূপে সংস্কারবাদী ছিলেন। আমার পিতার গ্রন্থাগারে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার খুব সমাদর ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতির রচনা ও উপদেশ ক্রমে ক্রমে আমার মনে ধর্মভাবের বীজ বপন করিয়াছিল। কোন শক্তিশালী ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব আমার মনের ধর্মবিশ্বাস গড়িয়া তোলে নাই। কোন অপৌরুষেয় ধর্মে আমি স্বভাবতই বিশ্বাস করিতাম না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ফ্রান্সিস উইলিয়াম নিউম্যানের রচনাবলী, ফ্রান্সেস পাউয়ার কব্ এবং রাজনারায়ণ বসুর পত্রাবলী, আমার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ‘জর্মাণ স্কুলের’ অন্যতম প্রতিনিধি ট্রস বাইবেলের যে নব্য সংস্কারমূলক আলোচনা করিয়াছিলেন, তাহাও আমার মনে লাগিত। ট্রস প্রণীত ‘Life of Christ the Man’ গ্রন্থে খৃষ্টের জীবনের অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলী বর্জিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ ব্রাহ্মসমাজের পূর্বাচার্যগণের বিশেষ প্রিয় ছিল। রেনানের ‘Life of Jesus’ গ্রন্থকেও এই পর্যায়ে ফেলা যায়। আমার পরিণত বয়সে মার্টিনের Endeavours After the Christian Life’ এবং ‘Hours of Thought’ থিওডোর পার্কার ও চ্যানিংএর রচনাবলী আমার নিত্য সহচর ছিল। বিশপ কোলেনসোর The Pentateuch Critically Examined’ নামক গ্রন্থ আমার পড়িবার সুযোগ হয় নাই। কিন্তু অন্য গ্রন্থে এই পুস্তকের যে উল্লেখ আছে, তাহাতেই আমি ইহার উদ্দেশ্য ও মর্ম উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি। পরবর্তী কালে, মুসা কর্তৃক প্রচারিত সৃষ্টির সময়পঞ্জী এবং পৃথিবীর বয়স সম্বন্ধে ভূবিদ্যার আবিষ্কার এই উভয়ের মধ্যে গভীর অনৈক্য অপৌরুষেয় ধর্মে আমার বিশ্বাস আরও নষ্ট করে। হিন্দু সমাজের প্রচলিত জাতিভেদ এবং তাহার আনুষঙ্গিক ‘অস্পৃশ্যতা’ আমার নিকট মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক সম্বন্ধের ঠিক বিপরীত