পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৪
মানিক রচনাসমগ্র

 গোকুলকে সে ধমক দেয় না ‘তুই থাম ছোঁড়া' বলে। তীব্র কুৎসিত মন্তব্য করে না মুক্তাকে ফিরিয়ে নেবার কল্পনারও বিরুদ্ধে! গোকুলের কথাতেই যেন প্রকারান্তরে সায় দিয়ে যোগ দেয়, ফিরবার কী দরকার ছিল ছুঁড়ির?

 গোকুল ইয়ার্কি দিয়ে কথাটা বলেছিল। কিন্তু ইয়ার্কিতেও বাস্তব যুক্তি টােল খায় না, হালকা হয় না।

 ছেঁড়া ময়লা ন্যাকড়া-জড়ানো কঙ্কাল ছিল মুক্তা। সকলের মতো সুদাসেরও চোখে পড়েছে মুক্তার শাড়িখানা। সকলের মতো সেও টের পেয়েছে মুক্তার দেহটি আজ বেশ পরিপুষ্ট।

 আঁকাবাঁকা রাস্তা, এপাড়া ওপাড়া হয়ে, পুকুর ডোবা বাঁশবন আমবাগান গাছপালা জঙ্গলে শান্ত। মুক্তা চেনে সংক্ষেপ পথ। যতটা পারা যায় বসতি এড়িয়ে চলতে আরও সে পথ সংক্ষেপ করে প্রায় অগম্য জঙ্গল মাঠ বাগানে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। তবু গাঁ তো অরণ্য হয়নি, পাড়া পেরোতে হয়, ঘন বসতি কোনটা, কোনটা ছড়ানো। ভদ্রমানুষেরা তাকায় একটু উদাসীন ভাবে, যারা গুজব শুনেছে তারাও, শুধু ভুরুগুলি তাদের একটু কুঁচকে যায় সকৌতুক কৌতুহলে। চাষাভুসোদের কমবয়সি মেয়ে-বউরা বেড়ার আড়াল থেকে উঁকি দেয়, উত্তেজিত ফিসফিসানি কথার আওয়াজ বেশ খানিকটা দূর পর্যন্তই পৌঁছায়। বয়স্করা প্রকাশ্যে এগিয়ে যায় পথের ধারে, কেউ কেউ মুক্তাকে কথা শোনায় খোঁচা-দেওয়া ছ্যাঁকা-লাগানো কথা। কেউ চুপ করে থাকে, কেমন একটা দরদ বোধ করে, বাছার কচি ছেলেটা মরেছে, কোথায় না জানি বাছা কত লাঞ্ছনা কত উৎপীড়ন সয়েছে ভেবে।

 মধু কামারের বউ গিরির মা একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকায় তার মস্ত ফোলা-ফাঁপা শরীর নিয়ে। মধু কামার নিরুদ্দেশ হয়েছে বছরখানেক, কিছুদিন আগে গিরিও উধাও হয়ে গেছে।

 ক্যান লা মাগি? গিরির মা মুক্তাকে শুধোতে থাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কুৎসিত গালাগালি দিয়ে দিয়ে, ক্যান ফিরেছিস গাঁয়ে, বুকের কী পাটা নিয়ে? ঝেঁটিয়ে তাড়াব তোকে। দূর-অ দূর-অ! যা।

 হাঁপাতে হাঁপাতে সে কথা বলে, যেন হলকায় হলকায় আগুন বেরিয়ে আসে হিংসার বিদ্বেষের। সুরমা স্মিতমুখে মিষ্টিকথায় তাকে থামাতে গিয়ে তার গালের ঝাঁঝে এক পা পিছিয়ে আসে। মনে হয় গিরির মা বুঝি শেষ পর্যন্ত আঁচড়ে কামড়েই দেবে মুক্তাকে। মুক্তা দাঁড়িয়ে থাকে নিস্পন্দ হয়ে। এরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

 মানুষ জমেছে কয়েকজন একজন, কোমরে গামছা-পরা আর মাথায় কাপড়খানা পাগড়ির মতো জড়ানো, হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে। একজন বলে, বাঃ। বাঃ বেশ। একজন উরুতে থাপড় মেরে গেয়ো ভঙ্গিতে হাততালি দেয়।

 একটু তফাতে নালা পেরোবার জন্য পাতা তালগাছের কাণ্ডটার এ মাথায় বসেছিল গদাধর, বহুদূরের মানুষকে হাঁক দেবার মতো জোর গলায় এমনি সময়ে সে ডাকে, গিরির মা। বলি ওগো গিরির মা।

 গিরির মা মুখ ফিরিয়ে তাকাতে সে আবার বলে তেমনি জোর গলায়, গিরি যে তোমায় ডাকছে গো গিরির মা কখন থেকে! শুনতে পাও না?

 গিরির মা থমকে যায়, দুঃস্বপ্ন-ভাঙা মানুষের মতো ক্ষণিক সংবিৎ খোঁজে বিমূঢ়ের মতো, তারপর যেন চোখের পলকে এলিয়ে যায়।

 ডাকছে? অ্যাঁ, ডাকছে নাকি গিরি? যাই লো গিরি, যাই।

 এতগুলি মানুষ দেখে লজ্জায় সে জিভ কাটে। কোমরে এক পাক জড়ানো ছেঁড়া কাঁথাখানা চট করে খুলে নিয়ে মাথায় ঘোমটার মতো চাপিয়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে।