পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র পঞ্চম খণ্ড.pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



নমুনা

কেবল কেশবের নয়, এ রকম অবস্থা আরও অনেকের হয়েছে। অন্ন নেই। কিন্তু অন্ন পাওয়ার একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে মেয়ের বিনিময়ে। কয়েক বস্তা অন্ন, মেয়েটির দেহের ওজনের দু-তিন গুণ। সেই সঙ্গে কিছু নগদ টাকাও, যা দিয়ে খানকয়েক বস্ত্র কেনা যেতে পারে।

 বছরখানেক আগেও কেশব ভালো ছেলে খুঁজেছে, নগদ গহনা জামা-কাপড় আর তৈজসপত্র সমেত শৈলকে দান করার জন্য। মেয়েকে যথাশাস্ত্র, যথাধর্ম, যথারীতি দান করতে সে সর্বস্বাস্ত হতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তার সর্বস্ব খুব বেশি না হওয়ায় যেমন তেমন চলনসই গ্রহীতাও জোটেনি। শৈলর রূপও আবার এদিকে চলনসই। অথচ বেশ সে বাড়ন্ত মেয়ে।

 খুঁজতে খুঁজতে কখন নিজের, স্ত্রীর, অন্য কয়েকটি ছেলেমেয়ের এবং ওই শৈলর পেটের অন্ন—এক পেটা, আধ পেটা, সিকি পেটা অন্ন—জোগাতে সর্বস্বাস্ত হয়ে গিয়েছে, ভালো করে বুঝবার অবকাশও কেশব পায়নি। বড়ো ছেলেটার বিয়ে দিয়েছিল, ছেলেটা চাকরি করত স্কুলে তেতাল্লিশ টাকার মাস্টারি। ছেলেটা মরেছে এক বিশেষ ধরনের বিস্ময়কর ম্যালেরিয়ায়। ম্যালেরিয়া জ্বর যে একশো ছয় ডিগ্রিতে ওঠে আর ভরিখানেক সোনার দামে যতটুকু গা-ফোঁড়া ওষুধ মেলে তা যথেষ্ট না হওয়ায় পাঁচ দিনের মধ্যে জোয়ান একটা ছেলে মরে যায় এমন ম্যালেরিয়ার গুণটাই শুধু কেশবের শোনা ছিল।

 আর একটা মেয়েও কেশবের মরেছে, সাধারণ ম্যালেরিয়ায়। এ ম্যালেরিয়া কেশবের ঘনিষ্ঠ ঘরোয়া শত্রু। এর অস্ত্র কুইনিনের সঙ্গেও তার পরিচয় অনেকদিনের। হরি হরি, মেয়েটার যখন এমনি কুইনিন গেলার ক্ষমতা ছিল না, জলে গুলে কুইনিন দিতে গিয়ে ময়দার আঠা তৈরি হয়ে গেল।

 সদয় ডাক্তার বলল, পাগল, ও খুব ভালো কুইনিন। নতুন ধরনের কুইনিন—খুবই এফেক্টিভ। নইলে দাম বেশি নিই। কখনও আপনার কাছে?

 মেয়েটা মরে যাওয়ার পর সদয় ডাক্তার রাগ করেছিল। হাকিমের রায় দেওয়ার মতো শাসনভরা নিন্দার সুরে বলেছিল, আপনারাই মারলেন ওকে। কুইনিন? শুধু কুইনিনে কখনও জ্বর সারে? পথ্য চাই না? পথ্য না দিয়ে মারলেন মেয়েটাকে, শুধু পথ্য না দিয়ে।

 শৈলর চেয়ে সে মেয়েটি ছোটাে ছিল মোটে বছর দেড়েকের। তার মুখখানাও ছিল শৈলর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। আজ তার বিনিময়ে অন্ন মিলতে পারত। কয়েক বস্তা অন্ন। নগদ টাকা ফাউ।

 কিন্তু সে জন্য কেশবের মনে কোনো আপশোশ নেই। সে বরং ভাবে যে মেয়েটা মরে বেঁচেছে। সেও বেঁচেছে।

 শৈলকে কিনল কালাচাঁদ।

 কালাচাঁদের মুখ বড়ো মিষ্টি। বড়োই মধুর ও পবিত্র তার কথা। মুখখানা তার ফরসা ও ফ্যাকাশে। ছোটাে ছোটাে চােখে স্তিমিত নিস্তেজ নিষ্কাম দৃষ্টি। রাবণের অধিকার বজায় থাকা পর্যন্ত ধাৰ্মিক বিভীষণ বরাবর যে দৃষ্টিতে কৃশোদরী মন্দােদরীকে দেখত, কালাচাঁদ সেই দৃষ্টিতেই মেয়েদের দেখে থাকে। এটুকু ছাড়া অবশ্য বিভীষণের সঙ্গে কালাচাঁদের তুলনা চলে না। বছর পাঁচেক আগে কালাচাঁদের দাদা কীভাবে যেন মারা যায়। দাদার দু নম্বর বেওয়ারিশ পত্নীটিকে স্নেহ করা দূরে থাক,