পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ (ሱ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সুলভ করতে চেয়েছে, তারা মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ গৌরবকে ধুলায় লুষ্ঠিত করে দিয়েছে। হে গুহাহিত, আমার মধ্যে যে গোপন পুরুষ, যে নিভৃতবাসী তপস্বীটি রয়েছে, তুমি তারই চিরন্তন বন্ধু ; প্ৰগাঢ় গভীরতার মধ্যেই তোমরা দুজনে পাশাপাশি গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে রয়েছ- সেই ছায়াগভীর নিবিড় নিস্তব্ধতার মধ্যেই তোমরা দ্বা সুৰ্পণা সাযুজা সখায়া । তোমাদের সেই চিরকালের পরমাশ্চর্য গভীর সখ্যকে আমরা যেন আমাদের কোনো ক্ষুদ্রতার দ্বারা ছোটাে করে না দেখি । তোমাদের ঐ পরম সখ্যকে মানুষ দিনে দিনে যতই উপলব্ধি করছে, ততই তার কাব্য সংগীত ললিতকলা অনির্বচনীয় রসের আভাসে রহস্যময় হয়ে উঠছে, ততই তার জ্ঞান সংস্কারের দৃঢ় বন্ধনকে ছিন্ন করছে, তার কর্ম স্বার্থের দুর্লঙ্ঘ্য সীমা অতিক্রম করছে, তার জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনন্তের ব্যঞ্জনা প্ৰকাশ পেয়ে উঠছে। তোমার সেই চিরন্তন পরম গোপনতার অভিমুখে আনন্দে যাত্রা করে চলব— আমার সমস্ত যাত্ৰাসংগীত সেই নিগৃঢ়তার নিবিড় সৌন্দর্যকেই যেন চিরদিন ঘোষণা করে- পথের মাঝখানে কোনো কৃত্রিমকে, কোনো ছোটােকে, কোনো সহজকে নিয়ে যেন ভুলে না থাকে- আমার আনন্দের আবেগধারা সমুদ্রে চিরকাল বহমান হবার সংকল্প ত্যাগ করে যেন মরুবালুকার ছিদ্রপথে আপনাকে পথিমধ্যে পরিসমাপ্ত করে না দেয় । ২৩ চৈত্র ১৩১৬ দুর্লভ ঈশ্বরের মধ্যে মনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, এই কথা অনেকের মুখে শোনা যায় । “পারি। নে যখন বলি তার অর্থ এই, সহজে পারি। নে ; যেমন করে নিশ্বাস গ্রহণ করছি, কোনো সাধনার প্রয়োজন হচ্ছে না, ঈশ্বরকে তেমন করে আমাদের চেতনার মধ্যে গ্ৰহণ করতে পারি। নে । কিন্তু গোড়া থেকেই মানুষের পক্ষে কিছুই সহজ নয় ; ইন্দ্ৰিয়বোধ থেকে আরম্ভ করে ধর্মবুদ্ধি পর্যন্ত সমস্তই মানুষকে এত সুদূর টেনে নিয়ে যেতে হয় যে মানুষ হয়ে ওঠা সকল দিকেই তার পক্ষে কঠিন সাধনার বিষয় । যেখানে সে বলবে ‘আমি পারি নৌ সেইখানেই তার মনুষ্যত্বের ভিত্তি ক্ষয় হয়ে যাবে, তার দুৰ্গতি আরম্ভ হবে ; সমস্তই তাকে পারতেই হবে। পশুশাবককে দাড়াতে এবং চলতে শিখতে হয় নি । মানুষকে অনেকদিন ধরে বার বার উঠে পড়ে তবে চলা অভ্যাস করতে হয়েছে ; “আমি পারি নো বলে সে নিস্কৃতি পায় নি। মাঝে মাঝে এমন ঘটনা শোনা গেছে, পশুমাতা মানবশিশুকে হরণ করে বনে নিয়ে গিয়ে পালন করেছে। সেই সব মানুষ জন্তুদের মতো হাতে পায়ে হাটে । বস্তুত তেমন করে ইটা সহজ । সেইজন্য শিশুদের পক্ষে হামাগুড়ি দেওয়া কঠিন নয় । কিন্তু মানুষকে উপরের দিকে মাথা তুলে খাড়া হয়ে দাড়াতে হবে । এই খাড়া হয়ে দাড়ানো থেকেই মানুষের উন্নতির আরম্ভ। এই উপায়ে যখনই সে আপনার দুই হাতকে মুক্তিদান করতে পেরেছে তখনই পৃথিবীর উপরে সে কর্তৃত্বের অধিকার লাভ করেছে। কিন্তু শরীরটাকে সরল রেখায় খাড়া রেখে দুই পায়ের উপর চলা সহজ নয় । তবু জীবনযাত্রার আরম্ভেই এই কঠিন কাজকেই তার সহজ করে নিতে হয়েছে ; যে মাধ্যাকর্ষণ তার সমস্ত শরীরের ভারকে নীচের দিকে টানছে, তার কাছে পরাভব স্বীকার না করবার শিক্ষাই তার প্রথম কঠিন শিক্ষা । বহু চেষ্টায় এই সোজা হয়ে চলা যখন তার পক্ষে সহজ হয়ে দাঁড়াল, যখন সে আকাশের আলোকের মধ্যে অনায়াসে মাথা তুলতে পারল, তখন জ্যোতিষ্কবিরাজিত বৃহৎ বিশ্বজগতের সঙ্গে সে আপনার সম্বন্ধ উপলব্ধি করে আনন্দ ও গৌরব লাভ করলে । এই যেমন জগতের মধ্যে চলা মানুষের কষ্ট করে শিখতে হয়েছে, সমাজের মধ্যে চলাও তাকে বহু কষ্টে শিখতে হয়েছে। খাওয়া পরা, শোওয়া বসা, চলা বলা, এমন কিছুই নেই। যা তাকে বিশেষ যত্নে অভ্যাস না করতে হয়েছে। কত রীতিনীতি নিয়মসংযম মানলে তবে চার দিকের মানুষের সঙ্গে তার আদানপ্ৰদান, তার