পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S O8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নারিকেল সমুদ্রের ধারের জমিতেই নারিকেলের সহজ। আবাস। আমাদের আশ্রমের মাঠ সেই সমুদ্রকুল থেকে বহুদূরে। এখানে অনেক যত্নে একটি নারিকেলকে পালন করে তোলা হয়েছে- সে নিঃসঙ্গ নিস্ফল নিস্তেজ । তাকে দেখে মনে হয় সে যেন প্ৰাণপণে ঋজু হয়ে দাড়িয়ে দিগন্ত অতিক্রম করে কোনো-এক আকাঙক্ষার ধনকে দেখবার চেষ্টা করছে । নির্বাসিত তরুর মজার মধ্যে সেই আকাঙক্ষা । এখানে আলোনা মাটিতে সমুদ্রের স্পর্শমাত্র নেই, গাছের শিকড় তার বাঞ্ছিত রস এখানে সন্ধান করছে, পাচ্ছে না ; সে উপবাসী, ধরণীর কাছে তার কান্নার সাড়া মিলছে না। আকাশে উদ্যত হয়ে উঠে তার যে সন্ধানদৃষ্টিকে সে দিগন্তপারে পাঠাচ্ছে দিনান্তে সন্ধ্যাবেলায় সেই তার সন্ধানেরই সজীব মূর্তির মতো পাখি তার দোদুল্যমান শাখায় প্রতিদিন ফিরে ফিরে আসে। আজ বসন্তে প্রথম কোকিল ডেকে উঠল। দক্ষিণ হাওয়ায় আজ কি সমুদ্রের বাণী এসে পীেছল, যে বাণী সমুদ্রের কুলে কুলে বধির মাটির সুপ্তিকে নিয়তই অশান্ত তরঙ্গমন্দ্রে আন্দোলিত করে তুলছে। তাই কি আজ সেই দক্ষিণসমুদ্র থেকে তার তাণ্ডবনৃত্যের স্পর্শ এই গাছের শাখায় শাখায় চঞ্চল । সমুদ্রের রুদ্রডমরুর জাগরণী কি এরই পল্লবমর্মরে তার ক্ষীণ প্ৰতিধ্বনি জাগিয়েছে। বিরহী তরু কি আজ আপনি অন্তরে সেই সুদূরবন্ধুর বার্তা পেল, যে বন্ধুর মহাগানে অভিনন্দিত হয়ে কোন অতীত যুগে একদিন কোনো প্ৰথম নারিকেল প্ৰাণ যাত্রীকরূপে জীবলোকে যাত্রা শুরু করেছিল ? সেই যুগারম্ভপ্ৰভাতের আদিম উৎসবে মহাপ্ৰাণের যে স্পর্শ পুলক জেগেছিল তাই আজ ফিরে পেয়ে কি ঐ গাছটির সংবৎসরের অবসাদ আজ বসন্তে ঘুচিল । তার জীবনের জয়পতাকা আবার আজ কি ঐ নব উৎসাহে নীলাম্বরে আন্দোলিত । যেন একটা আচ্ছাদন উঠে গেল, তার মজার মধ্যে প্ৰাণশক্তির যে আশ্বাসবাণী প্রচ্ছন্ন হয়েছিল তাকেই আজ কি ফিরে পেলে, যে বাণী বলছে— ‘চলো প্ৰাণতীর্থে, জয় করো মৃত্যুকে ।” সমুদ্রের কূল হতে বহুদূরে শব্দহীন মাঠে নিঃসঙ্গ প্ৰবাস তব, নারিকেল— দিনরাত্রি কাটে যে-প্রচ্ছন্ন আকাঙক্ষায় বুঝিতে পার না। তাহা নিজে । দিগন্তেরে অতিক্ৰমি দেখিতে চাহিছ তুমি কী-যে দীর্ঘ করি দেহ তব, মজ্জায় রয়েছে তার স্মৃতি গৃঢ় হয়ে । মাটির গভীরে যে রস খুঁজিছ নিতি কী স্বাদ পাও না তাহে, অন্নে তার কী অভাব আছে, তাই তো শিকড় উপবাসী, কঁদে ধরণীর কাছে । বাক্যহারা ! বারবার শূন্য হতে ফিরে ফিরে আসে তোমারি সন্ধানরূপী সন্ধ্যাবেলাকার শ্রান্ত পাখি লন্বিত শাখায় তব । ওই শুন উঠিয়াছে ডাকি বসন্তের প্রথম কোকিল । সে বাণী কি এল প্ৰাণে দক্ষিণপবন হতে, যে বাণী সমুদ্র শুধু জানে ; পৃথিবীর কূলে কুলে যে বাণী গভীর আন্দোলনে বধির মাটির সুপ্তি কঁপায়ে তুলিছে প্রতিক্ষণে অশান্ততরঙ্গমন্দ্রে, দক্ষিণসাগর হতে একি তাণ্ডবনৃত্যের স্পর্শ শাখার হিল্লোলে তব দেখি মুহুর্মুহু চঞ্চলিত ।