পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| | সহজ ও স্বাভাবিক হয়, অথচ তার কাজে কারো যেন মূল্য নাই কিছুই সে যেন গ্ৰাহ করে না। শুমার টাকা লইয়া পালানোর পর হইতে তাহার এই পাগলামি-না-করার পাগলামি আরম্ভ হইয়াছে। ধার করিয়া রাখালকে টাকা দেওয়ার অপরাধ, শ্যামার জমানে টাকাগুলি নষ্ট করার অপরাধ, তাহার কাছে অবশ্যই পুরানো হইয়া গিয়াছে, মনে আছে কিনা তাও সন্দেহ। মাস গেলে আগের টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকা আনিয়া সে শ্যামাকে দেয়, আগে হইলে এই লইয়া কত কাণ্ড করিত, হয় অনুতাপে সারা হইত, না হয় নিজে নিজে কলহ বাধাইয়া শ্যামাকে গাল দিয়া বলিত, যা সে আনিয়া দেয়। তাই যেন শ্যামা সোনামুখ করিয়া গ্ৰহণ করে, ঘরে বসিয়া গেলা যাহার একমাত্র কম। অত তাহার টাকার খাকতি কেন ?- এখন টেরও পাওয়া DB D DD BDB BDDDD g D DD BDBBSYS শ্যাম যদি নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কি করে যে মাস চালাব,- সে অমনি অমায়িক ভাবে বলিয়া বসে, ওতেই হবে গো, খুব চলে যাবে, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, ইয়ে করতে হয় না, কি করা অত টাকা ? কমল ঘোষের টাকাটা মাসে মাসে কিছু কম করিয়া দিলে হয়ত চলে, শীতলকে এ কথা বলিতে শু্যামার বাধে। ঋণ যত শীঘ্ৰ শোধ হইয়া যায় ততই ভাল। এদিকে খরচ চলিতে চাহে না । বিধানকে স্কুলে দেওয়ার পর খরচ বাড়িয়াছে, বই খাতা, স্কুলের মাহিনী, পোষাক, জলখাবারের পয়সা এ সব মিলিয়া অনেকগুলি টাকা বাহির হইয়া যায়। যেমন তেমন করিয়া ছেলেকে শু্যামা স্কুলে পাঠাইতে পারে না, ছেলের পরিচ্ছদ ও পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া যে তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল, নিতান্ত অভাবের সময়েও শ্যামা তাহা অগ্ৰাহ করিতে পারে না। খরচ সে কমাইয়াছে অন্য দিকে। সত্যভামার এতকালের চাকুরিটি গিয়াছে। নিজের জন্য সেমিজ ও কাপড় কেনা শু্যামা বন্ধ করিয়াছে, এ সব বেশি। পরিমাণে তাহার কোন দিনই ছিল না, চিরকাল জোড়াতালি দিয়া কাজ চালাইয়া আসিয়াছে, এখন বড় অসুবিধা হয়। স্বামীপুত্র ছাড়া বাড়িতে কেহ থাকে না। তাই রক্ষা, নতুবা লজ্জা বাচিত না । শীতল আর বিধান বাহিরে যায়, ওদের জামা কাপড় ছাড়া শ্যামা আর কিছু ধোপাবাড়ি পাঠায় না, বাড়িতে কাচিয়া লয়। ছেলেমেয়েদের দুধ সে কমাইতে পারে নাই, কমাইয়াছে মাছের পরিমাণ। মাঝে মাঝে ফল ও মিষ্টি আনাইয়া সকলকে খাওয়ানোর সাধ সে ত্যাগ করিায়াছে। এই ত্যাগটাই সব চেয়ে কষ্টকর। শ্যামার ছেলেমেয়ের ভাল জিনিস খাইতে বড় ভালবাসে। তবু, এই সব অভাব অনটনের মধ্যেও শ্যামার দিনগুলি সুখে কাটিয়া যায়। ছেলেমেয়েদের অসুখ বিসুখ নাই। শীতলের যাহাই হইয়া থাক, তাহাকে সামলাইয়া চলা সহজ। নিজের শরীরটাও শুষ্ঠামার এত ভাল আছে যে, এক সংসারের Seb সমস্ত খাটুনি খাটিতে তাহার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না, কাজ করিতে যেন ভালই লাগে। চৈত্র শেষ হইয়া আসিল। ছাদে দাড়াইলে বসাকদের বাড়ির পাশ দিয়া রেলের উচু বাঁধটার ধারে প্রকাণ্ড শিমূল গাছটা হইতে তুলা উড়িয়া যাইতে দেখা যায়। পূবে খানিকটা ফাক' মাঠের পরে টিনের বেড়ার ওপাশে ধানকলের প্ৰকাণ্ড পাকা অঙ্গন, কুলি মেয়েরা প্ৰত্যহ ধান মেলিয়া শুকাইতে দেয়, ধান খাইতে বাক বাধিয়া পায়রা নামিয়া আসে। পায়রার কাকের ওডিা দেখিতে শু্যামা বড় ভালবাসে, অতগুলি পাখি আকাশে বারবার দিক পরিবতন করে এক সঙ্গে, সকাল ও বিকাল হইলে উড়িবার সময় একসঙ্গে সবগুলি পায়রার পাখার নিচে রোদ লাগিয়া ঝকঝকি করিয়া উঠে, শ্যামা অবাক হইয়া ভাবে, কখন কোন দিক বাকিতে হইবে, সবগুলি পাখি একসঙ্গে টের পায় কি করিয়া ? ধানকলের এক কোণায় ছোট একটি পুকুর, ইঞ্জিন-ঘরের ওদিকে আরও একটা বড় পুকুর আছে, বয়লারের ছাই ফেলিয়া ছোট পুকুরটির একটি তীরকে ওরা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঠেলিয়া আনিয়াছে, পুকুরটা বুজাইয়া ফেলিবে বোধ হয়। ছাই ফেলিবার সময় বাতাসে রাশি রাশি ছাই সাদা মেঘের মত টিনের প্রচীর ডিঙ্গাইয়া, রেলের বাধা পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এসব শ্যামা যেমন ভাবে চাহিয়া দেখে কতকাল তেমনি ভাবে সে তা দেখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়া সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়, মণি বকুলের সঙ্গে ছান্দময় ছুটাছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যাম কাছে ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে, দেখিতে থাকে, বোধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক্য। পর পর অনেকগুলি গাড়ি রেললাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটি সিগনেলের পাখা বারবার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলি মেয়ের ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবিদ্যের মত অনেকগুলি স্তপ করে, তারপর হোগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া দেয়। ছোট পুকুরটিতে ধানকলের বাবু জাল ফেলান, মাছ বেশি পড়ে না, এতটুকু পুকুরে মাছ কোথায় দ্বি-জাল ফেলাই সার। শ্যামার হাসি পায়। তাহার মামাবাড়ির পুকুরে ও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইতে না, মাছের লেজের ঝাপটায় জল খান খান হইয়া যাইত। পারিপাৰ্থিক জগতের দৃশ্য ও ঘটনা শ্যামা এমনিভাবে খটিয়া খটিয়া উপভোগ করে, বাড়িঘর, ধানকল, রেললাইন, রাস্তার মানুষ, এসব আর কবে তাহার এত ভাল লাগিয়াছিল ?-অথচ মনে মনে আকরণ উদ্বেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভারবোধহাইতোলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকালের দিকে শঙ্করদের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কি ভাবনা হইয়াছে ? শীতল বলে, বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খোলতাই হচ্ছে গো, বয়েস কমছে নাকি দিনকে দিন ?