প্রাকৃতরস-শতদূষণী

উইকিসংকলন থেকে
প্রাকৃতরস-শতদূষণী
প্রাকৃতরস-শতদূষণী।

পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্য।

শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিসিদ্ধান্তসরস্বতী স্বামি

লিখিত।

শ্রী বিশ্ববৈষ্ণবরাজসভা হইতে

বৈষ্ণবসিদ্ধান্তভূষণ বিদ্যাবিনোদ ভক্তিশাস্ত্রী সম্প্রদায় বৈভবাচার্য্য

ভক্তিশাস্ত্রাচার্য্য

শ্রীযুক্ত জগদীশ দাসাধিকারী ভক্তিপ্রদীপ বি, এ,

প্রকাশিত।

দ্বিতীয় সংস্করণ

কৃষ্ণনগর, শ্রীভাগরত প্রেসে,

শ্রীযোগেন্দ্রচন্দ্র হালদার দ্বারা মুদ্রিত।

প্রকাশকের নিবেদন।

 জগতে উচ্চতর শ্রেণীর মানবগণের মধ্যে পারলৌকিক বিশ্বাস রাজ্যে ভ্রমণ করিবার তিনটী পথ আছে তাহা কর্ম্ম, জ্ঞান ও ভক্তি নামে প্রসিদ্ধ। বদ্ধদশায় জীবের অনিত্য ভোগময় ফলপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানকে কর্ম্মমার্গ, নশ্বরতা ত্যাগ করিয়া প্রাদেশিক অনিত্য ফল ত্যাগ করিয়া নির্ভেদ ব্রহ্মানুসন্ধানকে জ্ঞানমার্গ এবং কর্ম্মজ্ঞানাতীত প্রকৃতির অতীত, সেব্যবস্তু কৃষ্ণের অনুকূল অনুশীলনকে ভক্তিমার্গ বলে।

 ভক্তিমার্গে সাধন ও সাধ্যভেদে সাধন, ভাব ও প্রেমভক্তির অধিষ্ঠানত্রয় দেখিতে পাওয়া যায়। সাধ্য ভাবসমূহ ও প্রেমকে সাধনজাতীয় অনুশীলন জ্ঞান করিলে যে উৎপাত উপস্থিত হয় সেই অসুবিধার হস্ত হইতে উম্মুক্ত হওয়ার নাম অনর্থনিবৃত্তি। শ্রীগৌরসুন্দরের অপূর্ব্ব পরমচমৎকারময়ী লীলা ও সেই লীলার পরিকর গোস্বামীগণের অনুষ্ঠানাদি এই প্রবন্ধের আকরস্থান।

 যিনি স্বানুভব দ্বারা শ্রীগৌরসুন্দরের বর্ত্তমানকালোচিত অমল প্রসাদ লাভ করিয়াছেন এবং প্রচারকার্য্যে ইহার উপকারিতা জানিয়াছেন তাদৃশ মহাত্মার প্রসাদ সকলে লাভ করুন এরূপ ইচ্ছার বশবর্ত্তী হইয়া আমি শ্রীসজ্জন তোষণী পত্রিকা হইতে প্রাকৃতরসশতদূষণী স্বতন্ত্র ভাবে প্রকাশ করিলাম। পাঠক পাঠ করিয়া লাভবান হইলে আমরা তাঁহাদের উচ্ছিষ্টের ভিক্ষুক হইতে পারি।

 শ্রীভক্তিবিনোদ কিঙ্কর তৃনাদপিসুনীচ ও বৈষ্ণব নিন্দা অসহিষ্ণু

দীন জগদীশ দাসাধিকারী।

শ্রীশ্রীগুরুগৌরাঙ্গগান্ধর্ব্বিকাগিরিধরেভ্যো নমঃ।
প্রাকৃতরস-শতদূষণী।

প্রাকৃত-চেষ্টাতে ভাই কভু রস হয় না।
জড়ীয় প্রাকৃতরস শুদ্ধভক্ত গায় না॥
প্রাকৃতরসের শিক্ষা-ভিক্ষা শিষ্যে চায় না।
রতি বিনা যেই রস তাহা গুরু দেয় না॥
নাম রস দুই বস্তু ভক্ত কভু জানে না।
নাম রসে ভেদ আছে ভক্ত কভু বলে না॥
অহং মম ভাবসত্ত্বে নাম কভু হয় না।
ভোগবুদ্ধি না ছাড়িলে অপ্রাকৃত হয় না॥
প্রাকৃত জড়ের ভোগে কৃষ্ণ সেরা হয় না।
জড়বস্তু কোনও কালে অপ্রাকৃত হয় না॥
জড়সত্তা বর্ত্তমানে চিৎ কভু হয় না।
জড় বস্তু চিৎ হয় ভক্তে কভু বলে না॥
জড়ীয় বিষয় ভোগ ভক্ত কভু করে না।
জড়-ভোগ কৃষ্ণ-সেবা কভু সম হয় না॥
নিজ-ভোগ্য কামে ভক্ত প্রেম কভু বলে না।
রসে ডগমগ আছ শিষ্যে গুরু বলে না॥

রসে ডগমগ আমি কভু গুরু বলে না।
জড়ীয় রসের কথা শিষ্যে গুরু বলে না॥
জড়রসগানে কভু শ্রেয়ঃ কেহ লভে না।
কৃষ্ণকে প্রাকৃত বলি ভক্ত কভু গায় না॥
নামকে প্রাকৃত বলি কৃষ্ণে জড় জানে না।
কৃষ্ণনামরসে ভেদ শুদ্ধভক্ত মানে না॥
নাম রসে ভেদ আছে গুরু শিক্ষা দেয় না।
রস লাভ করি শেষে সাধন ত হয় না॥
কৃত্রিম পন্থায় নামে রসোদয় হয় না।
রস হৈতে কৃষ্ণ নাম বিলোমেতে হয় না॥
রস হইতে রতি শ্রদ্ধা কখনই হয় না।
শ্রদ্ধা হইতে রতি ছাড়া ভাগবত গায় না॥ ১৪
রতি যুক্ত রস ছাড়া শুদ্ধভক্ত বলে না।
সাধনেতে রতি রস গুরু কভু বলে না॥
ভাবকালে যে অবস্থা সাধনাগ্রে বলে না।
বৈধী শ্রদ্ধা সাধনেতে রাগানুগা হয় না॥
ভারের অঙ্কুর হ'লে বিধি আর থাকে না।
রাগানুগা শ্রদ্ধা মাত্রে জাতরতি হয় না॥

অজাতরতিকে কভু ভাবলব্ধ বলে না।
রাগানুগ সাধকেরে জাতভাব বলে না॥
রাগানুগ সাধকেরে লব্ধরস বলে না॥
রাগানুগা সাধ্যভাব রতি ছাড়া হয় না।
ভাবাঙ্কুর সমাগমে বৈধীভক্তি থাকে না॥
রুচিকে রতির সহ কভু এক জানে না।
রাগানুগা বলিলেই প্রাপ্তরস জানে না॥
বিধি-শোধ্য জনে কভু রাগানুগ বলে না।
সাধনের পূর্ব্বে কেহ ভাবাঙ্কুর পায় না॥
জড়ে শ্রদ্ধা না ছাড়িলে রতি কভু হয় না।
জাতভাব না হইলে রসিকত হয় না॥
জড় ভাব না ছাড়িলে রসিকত হয় না॥
মূলধন রসলাভ রতি বিনা হয় না।
গাছে না উঠিতে কাঁদি বৃক্ষমূলে পায় না॥
সাধনে অনর্থ আছে রসোদয় হয় না।
ভাবকালে নামগানে ছলরস হয় না॥
সিদ্ধান্তবিহীন হৈলে কৃষ্ণে চিত্ত লাগে না।
সম্বন্ধহীনের কভু অভিধেয় হয় না॥

সম্বন্ধ বিহীন জন প্রয়োজন পায় না।
কুসিদ্ধান্তে ব্যস্ত জন কৃঞ্চ-সেবা করে না॥
সিদ্ধান্ত অলস জম অনর্থতো ছাড়ে না।
জড়ে কৃষ্ণ ভ্রম করি কৃষ্ণ সেবা করে না॥
কৃষ্ণনামে ভক্ত জড়বুদ্ধি কভু করে না।
অনর্থ না গেলে নামে রূপ দেখা দেয় না॥
অনর্থ না গেলে নামে গুণ বুঝা যায় না।
অনর্থ না গেলে নামে কৃষ্ণ-সেবা হয় না।
রূপ গুণ লীলা স্ফুর্ত্তি নাম ছাড়া হয় না॥
রূপ গুণ লীলা হৈতে কৃষ্ণ নাম হয় না।
রূপ হৈতে নাম স্ফুর্ত্তি গুরু কভু বলে না॥
গুণ হৈতে নাম স্ফুর্ত্তি গুরু কভু বলে না।
লীলা হৈতে নাম স্ফুর্ত্তি রূপানুগ বলে না॥
নাম নামী দুই বস্তু রূপানুগ বলে না।
রস আগে রতি পাছে রূপাদুগ বলে না॥
রস আগে শ্রদ্ধা পাছে গুরু কভু বলে না।
রতি আগে শ্রদ্ধা পাছে রূপানুগ বলে না॥
ক্রম পথ ছাড়ি সিদ্ধি রূপানুগ বলে না।

মহাজন পথ ছাড়ি নব্য পথে ধায় না॥
অপরাধ সহ নাম কখনই হয় না।
নামে প্রাকৃতার্থ বুদ্ধি ভক্ত কভু করে না॥
অপরাধ যুক্ত নাম ভক্ত কভু লয় না।
নামেতে প্রাকৃত বুদ্ধি রূপানুগ করে না॥
কৃষ্ণরূপে জড়বুদ্ধি রূপানুগ করে না।
কৃষ্ণগুণে জড়বুদ্ধি রূপানুগ করে না॥
পরিকর বৈশিষ্টকে প্রাকৃত তো জানে না।
কৃষ্ণলীলা জড়তুল্য রূপানুগ বলে না॥
কৃষ্ণেতর ভোগ্য বস্তু কৃঞ্চ কভু হয় না।
জড়কে অনর্থ ছাড়া আর কিছু মানে না।
জড়াসক্তি বশে রসে কৃষ্ণজ্ঞান করে না॥
কৃষ্ণনাম কৃষ্ণরূপ কভূ জড় বলে না।
কৃষ্ণগুণ কৃষ্ণলীলা কভু জড় বলে না॥
জড় রূপ অনর্থেতে কৃষ্ণ ভ্রম করে না।
কৃষ্ণ-নামরূপগুণে জড়বুদ্ধি করে না॥
নামরূপগুণলীলা জড় বলি মানে না।
জড়নামরূপগুণে কৃষ্ণ কভু বলে না॥

জড়শূন্য অপ্রাকৃত নাম ছাড়া বলে না।
জড়শূন্য অপ্রাকৃত রূপ ছাড়া দেখে না॥
জড়শূন্য অপ্রাকৃত গুণ ছাড়া শুনে না।
জড়শূন্য অপ্রাকৃত লীলা ছাড়া সেবে না॥
অনর্থ থাকার কালে জড় রূপে মজে না॥
অনর্থ থাকার কালে জড় গুণে মিশে না।
অনর্থ থাকার কালে জড় লীলা ভোগে না।
অনর্থ থাকার কালে শুদ্ধনাম ছাড়ে না॥
অনর্থ থাকার কালে রস গান করে না।
অনর্থ থাকার কালে সিদ্ধি লব্ধ বলে না।
অনর্থ থাকার কালে লীলা গান করে না।
অনর্থ নিবৃত্তি কালে নামে জড় বলে না।
অনর্থ নিবৃত্তি কালে রূপে জড় দেখে না।
অনর্থ নিবৃত্তি কালে গুণে জড় বুঝে না।
অনর্থ নিবৃত্তি কালে জড় লীলা সেবে না।
রূপানুগ গুরু দেব শিষ্য হিংসা করে না।
গুরু ত্যজি জড়ে আশা কভু ভক্ত করে না।
মহাজনপথে দোষ কভু গুরু দেয় না।

গুরু মহাজনবাক্যে ভেদ কভু হয় না।
সাধনের পথে কাঁটা সদ্‌গুরু দেয় না।
অধিকার অবিচার রূপানুগ করে না।
অনর্থ অম্বিত দাসে রস শিক্ষা দেয় না।
ভাগবত পদ্য বলি কুব্যাখ্যাতো করে না॥
লোকসংগ্রহের তরে ক্রমপথ ছাড়ে না।
না উঠিয়া বৃক্ষোপরি ফল ধরি টানে না॥
রূপানুগ ক্রম পথ বিলোপ ত করে না।
অনর্থক অর্থ রলি কুপথেতে লয় না।
প্রাকৃত সহজ মত অপ্রাকৃত বলে না।
অনর্থ না গেলে শিষ্যে জাতরতি বলে না॥
অনর্থবিশিষ্ট শিষ্যে রসতত্ত্ব বলে না॥
অশক্ত কোমলশ্রদ্ধে রসকথা বলে না।
অনধিকারিরে রসে অধিকার দেয় না।
বৈধভক্তজনে কভু রাগানুগ জানে না॥
কোমলশ্রদ্ধকে কভু রসিকতো জানে না।
স্বল্পশ্রদ্ধজনে কভু জাতরতি মানে না॥
স্বল্পশ্রদ্ধজনে রস উপদেশ করে না॥

জাতরতি প্রৌঢ়-শ্রদ্ধ-সঙ্গ ত্যাগ করে না।
কোমলশ্রদ্ধেরে কভু রস দিয়া সেরে না॥
কৃষ্ণের সেবন লাগি জড় রসে মিশে না।
রসোদয়ে কোন জীবে শিষ্যবুদ্ধি করে না॥
রসিক ভকতরাজ কভু শিষ্য করে না।
রসিকজনের শিষ্য এই ভাব ছাড়ে না॥
সাধন ছাড়িলে ভাব উদয় তো হয় না।
রাগানুগ জানিলেই সাধনতো ছাড়ে না।
ভাব না হইলে কভু রসোদয় হয় না।
আগে রসোদয় পরে রত্যুদয় হয় না।
আগে রত্যুদয় পরে শ্রদ্ধোদয় হয় না।
রসাভীষ্ট লভি পরে সাধনতো হয় না॥
সামগ্রীর অমিলনে স্থায়ীভাব হয় না।
স্থায়ীভাব ব্যতিরেকে রসে স্থিতি হয় না॥
ভোগে মন জড়ে শ্রদ্ধা চিৎ প্রকাশ করে না।
নামে শ্রদ্ধা না হইলে জড়বুদ্ধি ছাড়ে না॥
জড়বুদ্ধি না ছাড়িলে নাম কৃপা করে না।
নাম কৃপা না করিলে লীলা শুনা যায় না।

নামকে জানিলে জড়, কাম দূর হয় না।
রূপকে মানিলে জড়, কাম দূর হয় না।
গুণকে বুঝিলে জড়, কাম দূর হয় না।
লীলাকে পূরিলে জড়ে কাম দূর হয় না।
নামে জড় ব্যবধানে রূপোদয় হয় না।
নামে জড় ব্যবধানে গুণোদয় হয় না।
জড়ভোগ ব্যবধানে লীলোদয় হয় না।
অপরাধ ব্যবধানে রসলাভ হয় না।
অপরাধব্যবধানে নাম কভু হয় না।
ব্যবহিত লীলাগানে কাম দূর হয় না।
অপরাধব্যবধানে সিদ্ধ-দেহ পায় না।
সেবোপকরণ কর্ণে না শুনিলে হয় না।
জড়োপকরণ দেহে লীলা শোনা যায় না।
সেবার উন্মুখ হলে জড়কথা হয় না।
নতুবা চিন্ময়কথা কভু শ্রুত হয় না॥


এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।