সন্ধ্যা সঙ্গীত/সুখের বিলাপ

উইকিসংকলন থেকে

সুখের বিলাপ।

অবশ নয়ন নিমীলিয়া,
সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া—
“নিতান্ত একেলা আমি,
কেহ—কেহ—কেহ নাই হেথা,
কেহ—কেহ—কেহ নাই মোর!

এমন জোছনা সুমধুর,
বাঁশরী বাজিছে দূর–দূর,
যামিনীর হসিত নয়নে
লেগেছে মৃদুল ঘুম-ঘোর।
নদীতে উঠেছে মৃদু ঢেউ;
গাছেতে নড়িছে মৃদু পাতা;
লতায় ফুটিয়া ফুল দুটি
পাতায় লুকায় তার মাথা;
মলয় সুদূর বন ভূমে
কাঁপায়ে গাছের ছায়া গুলি,
লাজুক ফুলের মুখ হতে
ঘোমটা দিতেছে খুলি খুলি!
এমন মধুর রজনীতে
একেলা রয়েছি বসিয়া,
যামিনীর হৃদয় হইতে
জোছনা পড়িছে খসিয়া!
হৃদয়ে একেলা শুয়ে শুয়ে
সুখ শুধু এই গান গায়—
“নিতান্ত একেলা আমি যে,
কেহ—কেহ—কেহ নাই হায়!”

আমি তারে শুধাইনু গিয়া—
“কেন, সুখ, কার কর আশা?”
সুখ শুধু কাঁদিয়া কহিল—
“ভালবাসা—ভালবাসা গো!
সকলি—সকলি হেথা আছে,
কুসুম ফুটেছে গাছে গাছে,
আকাশে তারকা রাশি রাশি,
জোছনা ঘুমায় হাসি হাসি,
সকলি—সকলি হেথা আছে,
সেই শুধু—সেই শুধু নাই,
ভালবাসা নাই শুধু কাছে!
নিতান্তই একেলা ফেলিয়া
ভালবাসা, গেলি কি চলিয়া?
আবার কি দেখা হবে রে?
আর কি রে ফিরিয়া আসিবি?
আর কি রে হৃদয়ে বসিবি?
উভয়ে উভের মুখ চেয়ে
আবার কাঁদিব কবে রে?
অভিমান ক’রে মোর পরে
দুখেরে কি করিলি বরণ?

তারি বুকে মাথা রেখে করিলি শয়ন?
তারি গলে দিলি মালা?
তারি হাতে দিলি হাত?
সতত ছায়ার মত
রহিলি কি তারি সাথ?
তাই আমি কুসুম-কাননে
নিতান্ত একেলা বসি রে,
জোছনা হাসিয়া কাঁদিতেছে
সুখের নিশির শিশিরে!

অবশ নয়ন নিমীলিয়া
সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া—
"এই তটিনীর ধারে, এই শুভ্র জোছনায়,
এই কুসুমিত বনে, এই বসন্তের বায়,
কেহ মোর নাই একেবারে,
তাই সাধ গেছে কাঁদিবারে।
আজি এ গভীর রজনীতে—
জোছনা মগন নীরবতা,
সুদূর বাঁশির মৃদু স্বর,
মলয়ের কানে কানে কথা,

সহসা জাগায়ে দিল মোরে,
চমকি চাহিনু ঘুম-ঘোরে,
ভালবাসা সে আমার নাই,
চারি দিকে শূন্য এই ঠাঁই;
ঘুমায়ে ছিলাম, ভাল ছিনু,
জাগিয়া একি এ নিরখিনু!
দেখিনু, নিতান্ত একা আমি,
কেহ মোর নাই একেবারে!
তাই সাধ গেছে কাঁদিবারে।
তাই সাধ যায় মনে মনে—
মিশাব এ যামিনীর সনে,
কিছুই রবে না আর প্রাতে,
শিশির রহিবে পাতে পাতে।
সাধ যায় মেঘটির মত,
কাঁদিয়া মরিয়া গিয়া আজি
অশ্রুজলে হই পরিণত?”
সুখ বলে—“এ জন্ম ঘুচায়ে
সাধ যায় হইতে বিষাদ।”
“কেন সুখ, কেন হেন সাধ?”
“নিতান্ত একা যে আমি গো—

কেহ যে—কেহ যে—নাই মোর।”
“সুখ কারে চায় প্রাণ তোর?
সুখ, কার করিস্ রে আশা?”
সুখ শুধু কেঁদে কেঁদে বলে
“ভালবাসা—ভালবাসা গো!”