তরুণের স্বপ্ন/গোড়ার কথা

উইকিসংকলন থেকে

গোড়ার কথা

 মানুষের জীবনে শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ়াবস্থা ও বার্দ্ধক্য আছে, জাতীয় জীবনেও সেইরূপ ক্রমান্বয়ে এই সব অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। মানুষ মরে এবং মৃত্যুর পর নূতন কলেবর ধারণ করে—জাতিও মরে এবং মরণের ভিতর দিয়ে নবজীবন লাভ করে। তবে ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে প্রভেদ এই যে, সব জাতি মৃত্যুর পর বেঁচে ওঠে না। যে জাতির অস্তিত্বের আর সার্থকতা নাই, যে জাতির প্রাণের সম্পদ একেবারে নিঃশেষ হয়েছে—সে জাতি ধরাপৃষ্ঠ থেকে লোপ পায় অথবা কীট পতঙ্গের মত কোনও প্রকারে জীবন ধারণ করতে থাকে এবং ইতিহাসের পৃষ্ঠার বাহিরে তার অস্তিত্বের আর নিদর্শন থাকে না।

 ভারতীয় জাতি একাধিবার মরেছে—কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারণ এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বাণী আছে যেটা জগৎ-সভায় শুনাতে হবে; ভারতের শিক্ষার (culture) মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না। শুধু তাই নয়—বিজ্ঞান, শিল্প, কলা, সাহিত্য, ব্যবসায়, বাণিজ্য—এ সব ক্ষেত্রেও আমাদের জাতি জগৎকে কিছু দেবে ও কিছু শেখাবে। তাই ভারতের মনীষিগণ কত তমোময় যুগের মধ্যেও নির্নিমেষ নয়নে ভারতের জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সন্ততি আমরা, আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য সফল না ক’রে কি মরতে পারি?

 মনুষ্যদেহ পঞ্চভূতে মিশলেও জীবাত্মা কখনও মরে না। তদ্রূপ মৃত্যুমুখে পতিত হ’লেও জাতির শিক্ষা, দীক্ষা ও সভ্যতার ধারাই তার আত্মা; জাতির সৃষ্টিশক্তি যখন বিলুপ্ত হয় তখন বুঝতে হবে যে জাতি মরতে বসেছে। আহার, নিদ্রা ও সন্তানোৎপাদন তখন তার কার্য্যতালিকা হ’য়ে দাঁড়ায় এবং গতানুগতিক পন্থা অনুসরণ করাই তার একমাত্র নীতি বলে পরিগণিত হয়। এ অবস্থায় পড়েও কোনও কোনও জাতি আবার বেঁচে ওঠে, যদি তার অস্তিত্বের সার্থকতা থাকে। অন্ধকারময় যুগ যখন জাতিকে এসে গ্রাস করে, তখন সে কোনও প্রকারে নিজের শিক্ষা, দীক্ষা ও সভ্যতার ধারা বাঁচিয়ে রাখে, অন্য জাতির সঙ্গে মিশে ভূত হয়ে যায় না। তারপর অদৃষ্ট বা ভগবানের ইঙ্গিতে আবার নব জাগরণ দেখা যায়। অন্ধকার ধীরে ধীরে অপসারিত হয়; প্রসুপ্ত জাতি আবার চোখ খোলে; তার সৃষ্টি-শক্তি ফিরে আসে। সহস্রদল পদ্মের মত জাতির প্রাণধর্ম্ম আবার ফুটে ওঠে এবং নব নব রূপে, নব নব ভাবে ও নব নব দিকে আত্মপ্রকাশ লাভ করে। এরূপ অনেক মৃত্যু ও জাগরণের ভিতর দিয়ে ভারতীয় জাতি চলে এসেছে, কারণ ভারতের একটা mission আছে,—ভারতীয় সভ্যতার একটা উদ্দেশ্য আছে যাহা আজও সফল হয় নাই।

 ভারতের এই mission-এ যার বিশ্বাস আছে—সেই ভারতবাসীই শুধু বেঁচে আছে। ভারতের তেত্রিশ কোটী লোক যে বাঁচার মত বেঁচে আছে এ-কথা সত্য নহে। ভারতের এবং বাঙ্গলার তরুণদের এই বিশ্বাস আছে—তাই তারা বেঁচে আছে।

 দেশান্তরে কারাবাসে মাসের পর মাস যখন কাটিয়েছি তখন প্রায়ই এই প্রশ্ন আমার মনে উঠত—“কিসের জন্য, কিসের উদ্দীপনায় আমরা কারাবাসের চাপে ভগ্নপৃষ্ঠ না হয়ে আরও শক্তিমান হয়ে উঠছি?” নিজের অন্তরে যে উত্তর পেতাম তার মর্ম্ম এই:—“ভারতের একটা mission আছে, একটা গৌরবময় ভবিষ্যৎ আছে; সেই ভবিষ্যৎ ভারতের উত্তরাধিকারী আমরাই। নূতন ভারতের মুক্তির ইতিহাস আমরাই রচনা করছি এবং করব। এই বিশ্বাস আছে বলেই আমরা সব দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারি, অন্ধকারময় বর্ত্তমানকে অগ্রাহ্য করতে পারি, বাস্তবের নিষ্ঠুর সত্যগুলি আদর্শের কঠিন আঘাতে ধূলিসাৎ করতে পারি। এই অটল, অচল বিশ্বাস আছে বলেই বাঙ্গলার তরুণ শক্তি মৃত্যুঞ্জয়।”

 এই “শ্রদ্ধা,” এই আত্মবিশ্বাস যার আছে সেই ব্যক্তিই সৃষ্টিক্ষম, সেই ব্যক্তিই দেশ-সেবার অধিকারী। জগতে মহৎ প্রচেষ্টা যাহা কিছু আছে তাহা মনুষ্যহৃদয়ের আত্ম-বিশ্বাস ও সৃষ্টিশক্তির প্রতিচ্ছায়া মাত্র। নিজের এবং জাতির উপর বিশ্বাস যার নাই, সে ব্যক্তি কোন্‌ বস্তু সৃষ্টি করতে পারে?

 বাঙ্গালীর অনেক দোষ আছে, কিন্তু বাঙ্গালীর একটা গুণ আছে যাতে তার অনেক দোষ ঢাকা পড়েছে এবং যার বলে সে আজ জগতের মধ্যে মানুষ বলে গণ্য। বাঙ্গালীর আত্মবিশ্বাস আছে, বাঙ্গালীর ভাবপ্রবণতা ও কল্পনাশক্তি আছে—তাই বাঙ্গালী বর্ত্তমান বাস্তব জীবনের সকল ত্রুটি, অক্ষমতা, অসাফল্যকে অগ্রাহ্য ক’রে মহান আদর্শ কল্পনা করতে পারে—সেই আদর্শের ধ্যানে ডুবে যেতে পারে এবং আপাতদৃষ্টিতে যাহা অসাধ্য, তাহা সাধন করবার চেষ্টা করতে পারে। এই কল্পনা শক্তি ও আত্মবিশ্বাস আছে বলেই বাঙ্গলা দেশে এত সাধক জন্মেছে এবং এখনও জন্মাবে। এই কারণে দুঃখ কষ্ট ও অত্যাচারের চাপে বাঙ্গালীর মেরুদণ্ড কখনও ভাঙ্গবে না। যে জাতির idealism (আদর্শ-প্রীতি) আছে সে জাতি তার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যন্ত্রণাক্লেশ সানন্দে বরণ করে নিতে পারে।

 অনেকে মনে করেন যে, suffering-এর (দুঃখ) মধ্যে বুঝি শুধু কষ্টই আছে, কিন্তু এ কথা সত্য নয়। Suffering-এর মধ্যে কষ্ট যেমন আছে—তেমনি একটা অপার আনন্দও আছে। এই আনন্দবোধ যার হয় নি তার কাছে কষ্ট শুধু কষ্টই; সে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের নিষ্পেষণে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের ভিতর একটা অনির্ব্বচনীয় আনন্দের আস্বাদ পেয়েছে—তার কাজে suffering একটা গৌরবের জিনিষ, সে দুঃখ কষ্টের চাপে মুমূর্ষু না হয়ে আরও শক্তিমান ও মহীয়ান হয়ে ওঠে। এখন জিজ্ঞাস্য বিষয় এই—“আনন্দের উৎস কোথায়?” ঘন ঘটাচ্ছন্ন অমানিশায় যে বিজলী চমকায়, তার উৎপত্তি কোথায়?” আমার মনে হয়, এই আনন্দের উৎপত্তি আদর্শানুরাগ থেকে। যে ব্যক্তি কোনও মহান আদর্শকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসার দরুণ দুঃখ যন্ত্রণা পায়, তার কাছে দুঃখ ক্লেশ অর্থহীন নয়। দুঃখ তার কাছে রূপান্তরিত হয়ে আনন্দ ব’লে প্রতীয়মান হয় এবং সেই আনন্দ অমৃতের মত তার শিরায় শিরায় শক্তি সঞ্চার করে দেয়। আদর্শের চরণে যে আত্মসমর্পণ করতে পারে, সে-ই কেবল জীবনের অর্থ বুঝতে পারে এবং জীবনের অন্তর্নিহিত রসের সন্ধান পেতে পারে।

 গত এপ্রিল মাসে ইনসিন জেলে একটি রুশীয় উপন্যাস পড়তে পড়তে ঠিক এই ভাবের প্রতিধ্বনি পেলাম। লেখক একজন নায়কের মুখ দিয়ে রুশ জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন:—

 There is still much suffering in store for the people, much of their blood will yet flow, squeezed out by the hands of greed; but for all that, all my suffering, all my blood is a small price for that which is already stirring in my breast, in my mind, in the marrow of my bones! I am already rich as a star is rich in golden rays. And I will bear all, will suffer all because there is within me a joy which no one, nothing can ever stifle! In this joy there is a world of strength!

 [আমাদের কপালে এখনও অনেক কষ্ট আছে; লোভী ও অত্যাচারীদের নিষ্পেষণে আমাদের অনেক রক্ত এখনও বইবে। তথাপি যে সত্য আমার চিত্তে, হৃদয়ের অন্তরে ও অস্থি মজার মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছে, তা পাবার জন্য যদি আমাকে সকল দুঃখকষ্ট ভোগ ও আমার সমস্ত রক্ত দান করতে হয়, তাহ’লেও বুঝব যে, অতি অল্প মূল্যে এতবড় সম্পত্তি পেয়েছি! সোণার কিরণমণ্ডিত তারকার মত আমার আজ ঐশ্বর্য্য! তাই আমি সকল যন্ত্রণা ক্লেশ সহ্য করব, সব দুঃখকষ্ট আমার বুকের মধ্যে টেনে নিব, কারণ আমি অন্তরে যে আনন্দ পেয়েছি তাকে পার্থিব কোনও বস্তুই চেপে রাখতে পারে না! এই আনন্দই অনন্ত শক্তির আকর!]

 নীলকণ্ঠকে আদর্শ করে যে ব্যক্তি বলতে পারে—আমার মধ্যে আনন্দের উৎস খুলে গেছে, তাই আমি সংসারের সকল দুঃখ কষ্ট নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে পারি; যে ব্যক্তি বলতে পারে—আমি সব যন্ত্রণা ক্লেশ মাথায় তুলে নিচ্ছি, কারণ এর ভিতর দিয়ে আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি—সেই ব্যক্তিই সাধনায় সিদ্ধ হয়েছে।

 আমাদের আজ এই সাধনায় সিদ্ধ হতে হবে। নূতন ভারত যারা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের কেবল দিয়ে যেতে হবে—সারাজীবন কেবল দিয়ে যেতে হবে—নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাঙ্গাল হয়ে যেতে হবে—প্রতিদানে কিছু না চেয়ে। নিঃশেষে জীবন দান করেই জীবনের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা এরূপ সাধক হবে তাদের সম্পদ থাকবে কেবল অন্তরের আত্মবিশ্বাস, আদর্শানুরাগ ও আনন্দবোধ।

 কয়েকদিন পূর্ব্বে আমার ছাত্রস্থানীয় একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াতে সে আমাকে কতকগুলি নৈরাশ্যব্যঞ্জক ও অবিশ্বাসপূর্ণ প্রশ্ন করে। তার প্রশ্নের ভাব এই, আমাদের দেশের কিছুতেই কিছু হবে না। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিবার পর সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে—কাউন্সিলে গিয়ে, গভর্ণমেণ্টকে বাধা প্রদান ক’রে ও মন্ত্রীদের তাড়িয়ে কি হবে? আমি উত্তরে বললাম—এসব না ক’রেই বা কি হবে? তার পর তার অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার ভাবকে লক্ষ্য করে আমি বললাম—“দেখ, তোমার বয়স আমার চেয়ে অনেক কম; আদর্শের প্রেরণায় তোমরা অসহযোগের পথে নেমেছ। আমার বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে আমার idealism (আদর্শানুরাগ) বেড়ে চলেছে, কিন্তু তোমার idealism দেখছি দিন দিন ক্ষীণ হয়ে পড়ছে।” তখন সে স্বীকার করলে যে, গত কয়েক বৎসরে নানা প্রকার আঘাত পেয়ে তার এরূপ ভাবান্তর হয়েছে।

 একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, গত দুই বৎসরে একটা সাময়িক অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার ভাব বাঙ্গলাদেশকে ছেয়ে ফেলেছে। এর ফলে আমাদের কর্ম্মশক্তি কতকটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে কিন্তু জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলবার সময় এসেছে। অন্তরের শত্রুর চেয়ে বড় শত্রু মানুষের আর হতে পারে না। তাই অবিশ্বাসরূপ গৃহশত্রুকে সর্ব্বাগ্রে জয় করতে হবে, তা হ’লেই বাইরের শত্রুকে আমরা জয় করতে পারব। আজ বাঙ্গালীকে আবার দুর্জ্জয় আত্মবিশ্বাস লাভ করতে হবে। আদর্শে বিশ্বাস, নিজের শক্তিতে বিশ্বাস, ভারতের গৌরবময় ভবিষ্যতে বিশ্বাস—এই বিশ্বাসের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের বিশ্ববিজয়ী হতে হবে।

 বাঙ্গালাদেশের বর্ত্তমান অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করলে দুই কারণে খুব আশা হয়:—(১) ব্যায়াম চর্চ্চা ও ভূপর্য্যটনের স্পৃহা (২) তরুণের জাগরণ। কাপুরুষ ব’লে বাঙ্গালীর একদিন পৃথিবীতে অপবাদ ছিল—সে অপবাদ এখন গেছে। বাঙ্গালীর পরম শত্রু যিনি, তিনিও বোধ হয় এখন বাঙ্গালীকে সে অপবাদ দিতে সাহসী হবেন না। এই কাপুরুষতার অপবাদ কে দিয়েছিল এবং কি উপায়ে সে অপবাদ বিদূরিত হয়েছে তা বাঙ্গালী মাত্রেই জানে—এখানে তার উল্লেখ করবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু শারীরিক দুর্ব্বলতার অপবাদ এখনও আছে—সে অপবাদ বাঙ্গালীকে দূর করতে হবে। বাঙ্গালী যে আজ এই অপবাদ দূর করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছে এবং এই উদ্দেশ্যে চতুর্দ্দিকে সমিতির প্রতিষ্ঠা চলেছে—ইহা বড় আনন্দের বিষয়। এই অপবাদ যদি চিরকালের তরে দূর করতে হয় তবে বাঙ্গালীকে জাতিহিসাবে সবল ও বীর্য্যবান হতে হবে। কয়েকজন ভুবনবিজয়ী পালোয়ান সৃষ্টি করলেই এ উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। কারণ এরূপ পালোয়ানের শক্তি ও শৌর্য্যের গুণে জাতির গৌরব বৃদ্ধি হলেও সাধারণ বাঙ্গালীর শক্তি বৃদ্ধি হবে না। জাতি-বিশেষের বিচার করতে হ’লে শুধু তার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের দেখলে চলবে না—সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ লোকেদের দিকেও তাকাতে হবে।

 বাঙ্গালীর যে আজকাল ভুপর্য্যটনের স্পৃহা জেগে উঠেছে, এটা সবচেয়ে আনন্দদায়ক। বাঙ্গালী যে আজ ঘরের কোণ ত্যাগ করে পায়ে হেঁটে, সাঁতার দিয়ে, সাইকেলে চড়ে দেশ বিদেশে ভ্রমণে বাহির হবে, বিশ বৎসর পূর্ব্বে কে এ কথা বিশ্বাস করত? অজানা দেশ দেখবার, অজানা পথে হাঁটবার, অজানা লোকের সঙ্গে পরিচিত হবার, এই যে ব্যাকুলতা—এর থেকেই জাতিগঠন ও সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। যে সব জাতি স্বীয় গণ্ডীর বাইরে যেতে চায় না বা যেতে অপারগ—তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। অপর দিকে যে সব জাতি বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করেও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে, তাদের দিন দিন দৈহিক ও মানসিক উন্নতি এবং সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্য বিস্তার হয়ে থাকে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল যখন গেয়েছিলেন—“আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতে মরি”—তখন তিনি আমাদের সামনে ভ্রান্ত আদর্শ উপস্থিত করেছিলেন। আমাদের এখন বলবার সময় এসেছে—

“আমি যাব না, যাব না, যাব না ঘরে
বাহির করেছে পাগল মোরে।”

ঘরের কোণ ছেড়ে আমাদের এখন বিশ্বের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে—নিজেদের দেশটাকে প্রত্যক্ষভাবে ভাল কর দেখতে হবে; তারপর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দেশান্তরে ভ্রমণ করতে হবে এবং অজানা অপরিচিত দেশ আবিষ্কার করতে হবে। যে জাতি এরূপ করতে পারে তার শারীরিক বল, সাহস, চরিত্রবল, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য-বিস্তার ও সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ জাতি যে আজ এত উন্নত এবং তারা যে এত বড় সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছে, তাদের প্রবল ভ্রমণেচ্ছা তার অন্যতম কারণ। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা আমরা পোষণ না করলেও দেশ-বিদেশে ঘুরলে আমাদের হৃদয়টা যে বড় হবে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যে বেড়ে যাবে, আত্মবিশ্বাস যে বলবান্‌ হবে, বুদ্ধিবৃত্তি যে বিকাশ লাভ করবে—এ বিষয়ে কি কোনও সন্দেহ আছে? তবে ভূপর্য্যটন থেকে ষোল আনা লাভ গ্রহণ করতে হলে প্রভূত ধনশালী আধুনিক আমেরিকান ভূপর্য্যটকদের মত না বেড়িয়ে যতদূর সম্ভব কষ্ট স্বীকার করে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চেপে, সাইকেলে চড়ে বেড়াতে হবে।

 আর একটা বড় আশাপ্রদ লক্ষণ এই যে, আজকাল প্রায় সব জেলায় যুবকদের মধ্যে একটা আন্দোলন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই চাঞ্চল্যই জীবনী-শক্তির স্পন্দন। তরুণদের প্রাণ জেগেছে, তারা এখন নিজেদের কর্ত্তব্য বুঝতে আরম্ভ করেছে—তাই এত জায়গায় যুবক-সমিতির অধিবেশন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে শুনতে পাওয়া যায় যে তরুণরা কাজ করতে প্রস্তুত হয়েছে কিন্তু তারা পথ ঠিক বুঝতে পারছে না। কেউ কেউ বলেন যে, নেতার অভাবে যুবকেরা কিছু করে উঠতে পারছে না। নেতা খুঁজে না পেলেও এবং পথ ঠিক বুঝতে না পারলেও তরুণরা যে জেগেছে এবং স্বীয় কর্ত্তব্য ও স্বীয় দায়িত্ব বুঝবার চেষ্টা করছে, এটা কম কথা নয়। এখন আমার বক্তব্য এই—নেতা যদি খুঁজে নাও পাও—তবে কি তোমরা চুপ করে বসে থাকবে? তোমরাই নেতা সৃষ্টি করে নিয়ে কাজে লেগে যাও। নেতা আকাশ থেকে পড়ে না—কাজের মধ্যে দিয়ে নেতা গড়ে ওঠে। তার পর—“কঃ পন্থা?” ব’লে তোমরা যে মাথার হাত দিয়ে বসেছ—তা করলে চলবে না। নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির আলোকে তোমরা নিজেরাই পথ আবিষ্কার কর। সমস্যাটা যত জটিল মনে কর, ততটা জটিল নয়। আমাদের আদর্শ এই যে, আমরা একটা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর জাতি গড়ে তুলতে চাই—যে জাতি জ্ঞান ও কর্ম্মে, শিক্ষা ও ধর্ম্মে পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীন জাতিদের পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে। অতএব জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই জাগরণ আনতে হবে। কোনও দিকটা বাদ দিলে চলবে না। যার যেরূপ শক্তি ও আকাঙ্ক্ষা, তাকে তদনুরূপ কর্ম্মক্ষেত্র ঠিক করে নিতে হবে। যার যেরূপ জন্মলব্ধ বা ভগবদ্দত্ত ক্ষমতা—তাকে সেই ক্ষমতাই ফুটিয়ে তুলে দেশমাতৃকার চরণে তাহা অঞ্জলিস্বরূপ নিবেদন করতে হবে।

 গত বিশ বৎসরের মধ্যে বাঙ্গালা দেশে অনেক সাধক, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানবিদ, কর্ম্মবীর ও জননায়ক আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকে স্বীয় কর্ত্তব্য সম্পাদন ক’রে দেশবাসীকে চোখের জলে ভাসিয়ে, পরলোক গমন করেছেন। তাঁহাদের পরিত্যক্ত স্থানের মধ্যে অনেকগুলি এখনও কেউ দখল করতে পারেন নাই। এটা কি বাঙ্গালীর পক্ষে কম লজ্জার কথা? বাঙ্গালী যদি বেঁচে থাকে তবে এই শূন্য স্থানের মধ্যে অধিকাংশগুলি যাতে শীঘ্র অধিকৃত হয় তার জন্য মানুষের সৃষ্টি হওয়া উচিত। জাতি যতদিন প্রকৃতপক্ষে বেঁচে থাকে ততদিন শূন্য স্থানগুলি এমন ভাবে পড়ে থাকে না—মহাপুরুষদের অন্তর্ধানের পর নূতন মনীষিগণ এসে তাঁদের স্থান অধিকার করেন। যে জাতি অনন্যমনা হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধনায় নিরত থাকে—সে জাতির মধ্যে কোনও দিকেই প্রকৃত মানুষের অভাব কখনও হয় না। বাঙ্গলার সাধনা এখনও পূর্ণাবয়ব ও সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হয় নাই—সেইজন্য মনীষী বা নায়কের প্রস্থানের পর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আসন অধিকৃত হয় না!

 সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন জাতিকে চোখের সামনে রেখে জাতীয় সাধনায় প্রবৃত্ত না হলে—সে সাধনা কখনও জয়যুক্ত ও সাফল্যমণ্ডিত হবে না। জাতীয় জীবনের বহুদিক আছে—সব দিক দিয়েই জাতিকে গড়ে তুলতে হবে। প্রাণের বন্যা যখন জাতির শরীরে প্রবেশ করবে তখন সব দিক দিয়েই তার বিকাশ হওয়া চাই। তা না হলে যে বস্তুর সৃষ্টি হবে তা কখনও সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে না।

 তরুণ বাঙ্গলাকে আত্মস্থ হতে হবে। বাহ্য শক্তির উপর নির্ভর না করে তাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। নূতন জাতি সৃষ্টির দায়িত্ব আজ তরুণ সম্প্রদায়ের উপর ন্যস্ত। এত বড় দায়িত্বপূর্ণ কর্ত্তব্য সম্পাদন করতে হলে জীবন পণ করে সাধনায় প্রবৃত্ত হতে হবে। আশার কথা এই যে, চারিদিকে এই সাধনার বিপুল আয়োজন চলছে। এই বিরাট যজ্ঞে শুধু আমরাই নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকব? তা হতেই পারে না; তাই বলি—হে আমার তরুণ জীবনের দল! এসো, আমরাও এই বাণী উচ্চারণ করে বেদীর সম্মুখে উপস্থিত হই—

“মন্ত্রং বা সাধয়েয়ম্‌ শরীরং বা পাতয়েয়ম্‌"

আশ্বিন, ১৩৩৩।