আলালের ঘরের দুলাল/৩০

উইকিসংকলন থেকে

৩০ মতিলালের বারাণসী গমন ও সৎসঙ্গ লাভে চিত্ত

শোধন; তাহার মাতা ও ভগিনীর দুঃখ, রামলাল

বরদা বাবুর সহিত সাক্ষাৎ—পরে তাহাদের মতিলালের

সঙ্গে দেখা, পথে ভয় ও বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন।


 সদুপদেশ ও সৎসঙ্গে সুমতি জন্মে, কাহার অল্প বয়সে হয় —কাহার অধিক বয়সে হইয়া থাকে। অল্প বয়সে সুমতি না হইলে বড় প্রমাদ ঘটে —যেমন বনে অগ্নি লাগিলে হু২ করিয়া দিগ্‌দাহ করে অথবা প্রবল বায়ু উঠিলে একেবারে বেগে গমন করত বৃক্ষ অট্টালিকাদি ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলে সেইরূপ শৈশবাবস্থায় দুর্মতি জন্মিলে ক্রমশঃ রক্তের তেজে সতেজ হওয়াতে ভয়ানক হইয়া উঠে। এ বিষয়ের ভুরি২ নিদর্শন সদাই দেখা যায়। কিন্তু কোন২ ব্যক্তি কিয়ৎকাল দুর্মতি ও অসৎ কর্ম্মে রত থাকিয়া অধিক বয়সে হঠাৎ ধার্ম্মিক হইয়া উঠে, ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ পরিবর্ত্তনের মূল সদুপদেশ বা সৎসঙ্গ। পরন্তু কাহারো দৈবাৎ কাহারো বা কোন ঘটনায় কাহারো বা একটি কথাতেই কখন২ হঠাৎ চেতনা হইয়া থাকে —এরূপ পরিবর্ত্তন অতি অসাধারণ।

 মতিলাল যশোহর হইতে নিরাশ হইয়া আসিয়া সঙ্গিদিগকে বলিলেন—আমার কপালে ধন নাই আর ধন অন্বেষণ করা বৃথা, এক্ষণে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে কিছু দিনের জন্য ভ্রমণ করিয়া আসি —তোমরা কেহ আমার সঙ্গে যাবে? সকলেই লক্ষ্মীর বরযাত্রী—অর্থ হাতে থাকিলে কাহাকেও ডাকিতে হয় না —অনেকে আপনা আপনি আসিয়া জুটে যায় কিন্তু অর্থাভাব হইলে সঙ্গী পাওয়া ভার। মতিলালের নিকট যাহারা থাকিত, তাহারা আমোদ-প্রমোদ ও অর্থের অনুরোধে আত্মীয়তা দেখাত —বস্তুত মতিলালের প্রতি তাহাদের কিছুমাত্র আন্তরিক স্নেহ ছিল না। তাহারা যখন দেখিল যে তাহার কোন যোত্র নাই —চতুর্দ্দিকে দেনা, বাবুয়ানা করা দূরে থাকুক আহারাদিও চলা ভার, তখন মনে করিল উহার সঙ্গে প্রণয় রাখার কি ফল? এক্ষণে ছট্‌কে পড়া শ্রেয়। মতিলাল ঐ প্রকার প্রশ্ন করিয়া দেখিলেন কেহই কোন উত্তর দেয় না। সকলেই ঢোঁক গিলিয়া এঁ ওঁ করিয়া নানা ওজর ও অন্যান্য বরাতের কথা ফেলে। তাহাদিগের ব্যবহারে মতিলাল বিরক্ত হইয়া বলিলেন —বিপদেই বন্ধু টের পাওয়া যায়, এতদিনের পর আমি তোমাদিগকে চিন্‌লাম —যাহা হউক এক্ষণে তোমরা আপন২ বাটী যাও, আমি দেশ ভ্রমণে চলিলাম। সঙ্গিরা বলিল —বড়বাবু! রাগ করিও না —আপনি বরং আগু যাউন আমরা আপন২ বরাৎ মিটাইয়া পশ্চাৎ জুট্‌ব। মতিলাল তাহাদের কথায় আর কাণ না দিয়া পদব্রজে চলিলেন এবং স্থানে২ অতিথি হইয়া ও ভিক্ষা মাঙ্গিয়া তিন মাসের পর বারাণসীতে উত্তরিলেন। এই প্রকার দুরবস্থায় পড়িয়া ক্রমাগত একাকী চিন্তা করাতে তাঁহার মনের গতি বিভিন্ন হইতে লাগিল। বহু ব্যয়ে নির্মিত মন্দির, ঘাট ও অট্টালিকা ভগ্ন হইয়া যাবার উপক্রম হইতেছে —বহু২ শাখায় বিস্তীর্ণ তেজস্বী প্রাচীন বৃক্ষের জীর্ণাবস্থা দৃষ্ট হইল —নদ নদী, গিরি-গুহার অবস্থা চিরকাল সমান থাকে না —ফলতঃ কালেতে সকলেরই পরিবর্ত্তন ও ক্ষয় হইয়া থাকে —সকলই অনিত্য —সকলই অসার। মানবগণও রোগ, জরা, বিয়োগ, শোক ও নানা দুঃখে অভিভূত ও সংসারে সদা মাৎসর্য্য ও আমোদ সকলই জলবিম্ববৎ। মতিলাল ঐ সকল ধ্যান করিয়া প্রতিদিন বারাণসী ধামের চতুর্দ্দিকে প্রদক্ষিণ করত বৈকালে গঙ্গাতীরস্থ এক নির্জন স্থানে বসিয়া দেহের অসারত্ব, আত্মার সারত্ব, এবং আপন চরিত্র ও কর্ম্মাদি পূনঃ২ চিন্তা করিতে লাগিলেন। এইরূপ চিন্তা করাতে তাঁহার তমঃ খর্ব্ব হইতে লাগিল সুতরাং আপনার পূর্ব্ব কর্ম্মাদি ও উপস্থিত দুর্মতি প্রভৃতি জাগরূক হইয়া উঠিল। মনের এবম্প্রকার গতি হওয়াতে তাঁহার আপনার প্রতি ধিৎকার জন্মিল এবং ঐ ধিৎকারে অত্যন্ত সন্তাপ হইতে লাগিল। তখন আপনাকে সর্ব্বদা এই জিজ্ঞাসা করিতেন —আমার পরিত্রাণ কিরূপে হইতে পারে —আমি যে কুকর্ম্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখনও হৃদয় দাবানলের ন্যায় জ্বলিয়া উঠে। এইরূপ ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন —আহারাদি ও পরিধেয় বস্ত্রাদির প্রতি দৃক্‌পাতও নাই —ক্ষিপ্তপ্রায় ভ্রমণ করিয়া বেড়ান। কিছুকাল এই প্রকারে ক্ষেপণ হইলে দৈবাৎ এক দিবস দেখিলেন একজন প্রাচীন পুরুষ তরুতলে বসিয়া মনঃসংযোগ পূর্ব্বক এক২ বার একখানি গ্রন্থ দেখিতেছেন ও এক২ বার চক্ষু মুদিত করিয়া ধ্যান করিতেছেন। ঐ ব্যক্তিকে দেখিলে হঠাৎ বোধ হয় সে বহুদর্শী —জ্ঞানের সারাংশ গ্রহণ এবং মনঃসংযম বিলক্ষণ হইয়াছে। তাঁহার মুখ দর্শন করিলে তৎক্ষণাৎ ভক্তির উদয় হয়। মতিলাল তাঁহাকে দেখিবামাত্রে নিকটে যাইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেন। কিয়ৎকাল পরে ঐ প্রাচীন পুরুষ মতিলালের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন —বাবা! তোমার আকার প্রকারে বোধ হয় তুমি ভদ্র সন্তান —কিন্তু এমত সন্তাপিত হইয়াছ কেন? এই মিষ্ট কথায় উৎসাহ পাইয়া মতিলাল অকপটে আনুপূর্ব্বিক আপন পরিচয় দিয়া কহিলেন —মহাশয়! আপনাকে অতি বিজ্ঞ দেখিতেছি —আমি আপনার দাস হইলাম —আমাকে কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিউন। সেই প্রাচীন পুরুষ বলিলেন— দেখিতেছি তুমি ক্ষুধার্ত্ত— কিঞ্চিৎ আহার ও বিশ্রাম কর পরে সকল কথাবার্ত্তা হইবে। সে দিবস আতিথ্যে গেল—সেই প্রাচীন পুরুষ মতিলালের সরল চিত্ত দেখিয়া তুষ্ট হইলেন। মানব স্বভাব এই যে পরস্পরের প্রতি সন্তোষ না জন্মিলে মন খোলাখুলি হয় না, প্রথম আলাপেই যদি এমত তুষ্টি জন্মে তাহা হইলে পরস্পরের মনের কথা শীঘ্রই ব্যক্ত হয়, আর একজন সারল্য প্রকাশ করিলে অন্য ব্যক্তি অতিশয় কপট না হইলে কখনই কপটতা প্রকাশ করিতে পারে না। ঐ প্রাচীন পুরুষ অতি ধার্ম্মিক, মতিলালের সরলতায় তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পারমার্থিক বিষয়ে তাঁহার যে অভিপ্রায় ছিল তাহা ক্রমশঃ ব্যক্ত করিলেন। তিনি বারম্বার বলিলেন —বাবা! সকল ধর্ম্মের তাৎপর্য্য এই কায়মনোচিত্তে ভক্তি স্নেহ ও প্রেম প্রকাশপূর্ব্বক পরমেশ্বরের উপসনা করা, এই কথাটি সর্ব্বদা ধ্যান কর ও মন, বাক্য ও কর্ম্ম দ্বারা অভ্যাস কর। এই উপদেশটি তোমার মনে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইলেই মনের গতি একেবারে ফিরিয়া যাবে, তখন অন্যান্য ধর্ম্ম অনুষ্ঠান আপনা আপনি হইবে কিন্তু পরমেশ্বরের প্রেমার্থ মনের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা ও কর্ম্মের দ্বারা সদা একরূপ থাকা অতি কঠিন —সংসারে রাগ, দ্বেষ, লোভ, মোহ ইত্যাদি রিপু সকল বিজাতীয় ব্যাঘাত করে এজন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তার অত্যন্ত আবশ্যক। মতিলাল উক্ত উপদেশ গ্রহণপূর্ব্বক মনের সহিত প্রতিদিন পরমেশ্বরের ধ্যান ও উপাসনায় রত এবং আত্মদোষানুসন্ধানে ও শোধনে সযত্ন হইলেন। কিছুকাল এইরূপ করাতে তাঁহার মনোমধ্যে জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তির উদয় হইল। সাধুসঙ্গের কী অনির্ব্বচনীয় মাহাত্ম্য! যিনি মতিলালের উপদেশক, তিনি ধার্ম্মিক চূড়ামণি, তাঁহার সহবাসে মতিলালের যে এমন মতি হইবে ইহা কোন্‌ বিচিত্র।

 পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে যাবতীয় মনুষ্যের প্রতি মতিলালের মনে ভ্রাতৃবৎ ভাব জন্মিল —তখন পিতা মাতা ও পরিবারের প্রতি স্নেহ, পরদুঃখ মোচন ও পরহিতার্থ বাসনা উত্তরোত্তর প্রবল হইতে লাগিল। সত্য ও সরলতার বিপরীত দর্শন অথবা শ্রবণ হইলেই বিজাতীয় অসুখ হইত। মতিলাল আপন মনের ভাব ও পূর্ব্ব কথা সর্ব্বদাই ঐ প্রাচীন পুরুষের নিকট বলিতেন ও মধ্যে২ খেদ করিয়া কহিতেন —গুরো! আমি অতি দুরাত্মা, পিতা, মাতা, ভাই, ভগিনী ও অন্যান্য লোকের প্রতি যে প্রকার ব্যবহার করিয়াছি তাহাতে নরকেও যে আমার স্থান হয় এমন বোধ হয় না। ঐ প্রাচীন পুরুষ সান্ত্বনা করিয়া বলিতেন —বাবা! তুমি প্রাণপণে সদভ্যাসে রত থাকো —মনুষ্য মাত্রেই মনজ, বাক্যজ ও কর্ম্মজ পাপ করিয়া থাকে, পরিত্রাণের ভরসা কেবল সেই দয়াময়ের দয়া —যে ব্যক্তি আপন পাপ জন্য অন্তঃকরণের সহিত সন্তাপিত হইয়া আত্মশোধনার্থ প্রকৃতরূপে যত্নশীল হয় তাহার কদাপি মার নাই। মতিলাল এ সকল শুনেন ও অধোবদন হইয়া ভাবেন এবং সময়ে২ বলেন আমার মা, বিমাতা, ভগিনী, ভ্রাতা, স্ত্রী —ইঁহারা কোথায় গেলেন? ইঁহাদের জন্য মন উচাটন হইতেছে।

 শরতের আবির্ভাব —ত্রিযামা অবসান —বৃন্দাবনের কিবা শোভা! চারি দিকে তাল, তামাল, শাল, পিয়াল, বকুল আদি নানাজাতি বৃক্ষ —তদুপরি সহস্র২ পক্ষী নানা রবে গান করিতেছে —বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে —যমুনার তরঙ্গ যেন রঙ্গচ্ছলে পুলিনের একাঙ্গ হইতেছে —ব্রজবালক ও ব্রজবালিকারা কুঞ্জে২ পথে পথে বীণা বাজাইয়া ভজন গাইতেছে। নিশাবসানে দেবালয় সকলে মঙ্গলারতির সময় সহস্র২ শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনি হইতেছে। কেশী ঘাটে কচ্ছপ সকল কিল্‌বিল্‌ করিতেছে —বৃক্ষাদির উপরে লক্ষ২ বানর উল্লম্ফন প্রোল্লম্ফন করিতেছে —কখন লাঙ্গুল জড়ায় —কখন প্রসারণ করে —কখন বিকট বদন প্রদর্শন পূর্ব্বক ঝুপ্ করিয়া পড়িয়া লোকের খাদ্য সামগ্রী কাড়িয়া লয়।

 নানা বনে শত২ তীর্থযাত্রী পরিক্রমণ করিতেছে —নানা স্থান দর্শন করিয়া শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলার কথা কহিতেছে। এদিকে প্রখর রবি —মৃত্তিকা উত্তপ্ত —পদব্রজে যাওয়া অতি কঠিন, এ কারণ অনেক যাত্রী স্থানে২ বৃক্ষতলে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে। মতিলালের মাতা কন্যার হাত ধরিয়া ভ্রমণ করিতেছিলেন, অত্যন্ত শ্রান্তিযুক্ত হওয়াতে একটি নির্জ্জন স্থানে বসিয়া কন্যার ক্রোড়ে মস্তক রাখিয়া শয়ন করিলেন। কন্যা আপন অঞ্চল দিয়া আক্লান্ত মাতার ঘর্ম্ম মুছিয়া বাতাস করিতে লাগিল। মাতা কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইয়া বলিলেন —প্রমদা! বাছা তুই একটু বিশ্রাম কর —আমি উঠে বসি। কন্যা উত্তর করিল —মা! তোমার শ্রান্তি দূর হওয়াতেই আমার শ্রান্তি গিয়াছে —তুমি শুয়ে থাক আমি তোমার দুটি পায়ে হাত বুলাই। কন্যার এইরূপ সস্নেহ বাক্য শুনিয়া মাতা সজল নয়নে বলিলেন —বাছা! তোর মুখ দেখেই বেঁচে আছি —জন্মান্তরে কত পাপ করেছিলাম, তা না হলে এত দুঃখ কেন হবে? আপনি অনাহারে মরি তাতে খেদ নাই, তোকে এক মুটা খাওয়াই এমন সঙ্গতি নাই —এই আমার বড় দুঃখ! এ দুঃখ রাখবার কি ঠাঁই আছে? আমার দুটি পুত্র কোথায়? বৌটি বা কেমন আছে? কেনই বা রাগ করে এলাম? মতি আমাকে মেরেছিল —মেরেইছিল, ছেলেতে আবদার করে কিনা বলে —কিনা করে? এখন তার আর রামের জন্যে আমার প্রাণ সর্ব্বদাই ধড়ফড়্ করে। কন্যা মাতার চক্ষের জল মুছাইয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে মাতার একটু তন্দ্রা হইল। কন্যা মাতাকে নিদ্রিত দেখিয়া সুস্থির হইয়া বসিয়া একটু২ বাতাস দিতে আরম্ভ করিল। দুহিতার শরীরে মশা ও ডাঁশ বসিয়া কামড়াইতে লাগিল কিন্তু পাছে মায়ের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এজন্য তিনি স্থির হইয়া থাকিলেন। স্ত্রীলোকেদের স্নেহ ও সহিষ্ণুতা আশ্চর্য্য! বোধ হয় পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক এ বিষয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। মাতা নিদ্রাবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছেন যেন একটি পীতবসন নবকিশোর তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিতেছেন —“মা! তুই আর কাঁদিস্‌ না —তুই বড় পুণ্যবতী —অনেক দুঃখি-কাঙ্গালির দুঃখ নিবারণ করিয়াছিস —তুই কাহার ভাল বই কখন মন্দ করিস নাই। —তোর শীঘ্র ভাল হবে —তুই দুই পুত্র পাইয়া সুখী হইবি।” দুঃখিনী মাতা চম্‌কিয়া উঠিয়া চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখেন কেবল কন্যা নিকটে আছে আর কেহই নাই। পরে কন্যাকে কিছু না বলিয়া তাহার হস্ত ধারণপূর্ব্বক বহু ক্লেশে আপনাদের কুঞ্জে প্রত্যাগমন করিলেন।

 মায়ে-ঝিয়ে সর্ব্বদা কথোপকথন হয় —মা বলেন, বাছা! মন বড় চঞ্চল হইতেছে, বাড়ি যাব সর্ব্বদা এই ভাবতেছি। কন্যা কিছুই উপায় না দেখিয়া বলিল —মা! আমাদিগের সম্বলের মধ্যে দুই একখানি কাপড় ও জল খাবার ঘটীটি আছে —ইহা বিক্রয় করিলে কি হতে পার্‌বে? কিছু দিন স্থির হও আমি রাঁধুনী অথবা দাসীর কর্ম্ম করিয়া কিছু সঞ্চয় করি তাহা হইলেই আমাদের পথ খরচের সংস্থান হইবে। মা এ কথা শুনিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিস্তব্ধ থাকিলেন, চক্ষের জল আর রাখিতে পারিলেন না। মাতাকে কাতর দেখিয়া কন্যাও কাতর হইল। নিকটে একজন ব্রজবাসিনী থাকিতেন, তিনি সর্ব্বদা তাহাদিগের তত্ত্ব লইতেন, দৈবাৎ ঐ সময়ে আসিয়া তাহাদিগকে দুঃখিত দেখিয়া সান্ত্বনা করণানন্তর সকল বৃত্তান্ত শুনিলেন। তাহাদিগের দুঃখে দুঃখিত হইয়া সেই ব্রজবাসিনী বলিলেন —মায়ী! কি বলব আমার হাতে কড়ি নাই —আমার ইচ্ছা হয় সর্ব্বস্ব দিয়া তোমাদের দুঃখ মোচন করি, এখন একটি উপায় বলে দি তোমরা তাই কর। শুনিতে পাই এক বাঙ্গালী বাবু চাকরি ও তেজারতের দ্বারা কিছু বিষয় করিয়া মথুরায় আসিয়া বাস করিতেছেন —তিনি বড় দয়ালু ও দাতা, তোমরা তাঁর কাছে গিয়া পথ খরচ চাহিলে অবশ্যই পাইবে। দুঃখিনী মাতা ও কন্যা অন্য কোনো উপায় না দেখাতে প্রস্তাবিত উপায়ই অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহারা ব্রজবাসিনীর নিকট বিদায় লইয়া দুই দিনের মধ্যে মথুরায় উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক সরোবরের নিকটে যাইয়া দেখেন কতকগুলিন আতুর, অন্ধ, ভগ্নাঙ্গ, দুঃখী, দরিদ্র লোক একত্র বসিয়া রোদন করিতেছে। মাতা তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীনা স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন —বাছা! তোমরা কাঁদিতেছ কেন? ঐ স্ত্রীলোক বলিল —মা! এখানে এক বাবু আছেন তাঁহার গুণের কথা কি বলিব? তিনি গরীব দুঃখীর বাড়ি২ ফিরিয়া তাহাদের খাওয়া-পরা দিয়া সর্ব্বদা তত্ত্ব লয়েন আর কাহার ব্যারাম হইলে আপনি তার শেওরে বসিয়া সারারাত্রি জাগিয়া ঔষধ-পথ্য দেন। তিনি আমাদের সকলের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী। সেই বাবুর গুণ মনে করতে গেলে চক্ষে জল আইসে —যে মেয়ে এমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিয়াছেন তিনিই ধন্য —তাঁহার অবশ্যই স্বর্গ ভোগ হইবে —এমন লোক যেখানে বাস করেন সে স্থান পুণ্য স্থান। আমাদিগের পোড়া কপাল যে ঐ বাবু এখন এ দেশ হইতে চলিলেন —এর পর আমাদের দশা কি হবে তাই ভাবিয়া কাঁদ্‌ছি। মাতা ও কন্যা এই কথা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন—বোধ হয় আমাদিগের আশা নিষ্ফল হইল —কপালে দুঃখ আছে, ললাটের লিপি কে ঘুচাইবে? উক্ত প্রাচীনা তাহাদিগের বিষণ্ণ ভাব দেখিয়া বলিল, —আমার অনুমান হয় তোমারা ভদ্র ঘরের মেয়ে —ক্লেশে পড়িয়াছ। যদি কিছু টাকাকড়ি চাহ তবে এই বেলা আমার সঙ্গে ঐ বাবুর নিকটে যাবে চল, তিনি গরীব-দুঃখী ছাড়া অনেক ভদ্রলোকেরও সাহায্য করেন। মাতা ও কন্যা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং সেই বৃদ্ধার পশ্চাৎ২ যাইয়া আপনারা বাটীর বাহিরে থাকিলেন, বুড়ী ভিতরে গেল।

 দিবা অবসান —সূর্য্য অস্ত হইতেছে —দিনকরের কিরণে বৃক্ষাদির ও সরোবরের বর্ণ সুবর্ণ হইতেছে। যেখানে মাতা ও কন্যা দাঁড়াইয়াছিলেন সেখানে একখানি ছোট উদ্যান ছিল। স্থানে২ মেরাপে নানা প্রকার লতা, চারিদিকে কেয়ারি ও মধ্যে২ এক২ চবুতারা। ঐ বাগানের ভিতরে দুইজন ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করিয়া কৃষ্ণার্জ্জুনের ন্যায় বেড়াইতে ছিলেন। দৈবাৎ ঐ দুই স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে তাঁহারা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বাগান হইতে বাহির হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আসিলেন। মাতা ও কন্যা তাঁহাদিগকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া একটু অন্তরে দাঁড়াইলেন। ঐ দুইজন ভদ্রলোকের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি কোমল বাক্যে বলিলেন —আপনারা আমাদিগকে সন্তানস্বরূপ বোধ করিবেন —লজ্জা করিবেন না —আপনারা কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন, আমাদিগের নিকট বিশেষ করিয়া বলুন, যদি আমাদিগের দ্বারা কোন সাহায্য হইতে পারে আমরা তাহাতে কোন প্রকার ক্রটি করিব না। এই কথা শুনিয়া মাতা কন্যার হাত ধরিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রবর্ত্তিনী হইয়া আপন অবস্থা সংক্ষেপে ব্যক্ত করিলেন। তাঁহার কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে ঐ দুইজন ভদ্রলোক পরস্পর মুখাবলোকন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি একেবারে মায়াতে মুগ্ধ হইয়া মা মা বলিয়া ভূমিতে পড়িয়া গেলেন, অন্য আর একজন অধিকবয়স্ক ব্যক্তি দুঃখিনী মাতার চরণে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন —মা গো! দেখ কি? যে ভূমিতে পড়িয়াছে সে তোমার অঞ্চলের ধন —সে তোমার রাম, আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস। মাতা এই কথা শুনিবা মাত্রে মুখের কাপড় খুলিয়া বলিলেন —বাবা! তুমি কি বলিলে? এ অভাগিনীর কি এমন কপাল হবে? রামলাল চৈতন্য পাইয়া চরণে মস্তক দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, জননী পুত্রের মস্তক ক্রোড়ে রাখিয়া অশ্রুপাত করিতে২ তাহার মুখাবলোকন করিয়া আপন তাপিত মনে সান্ত্বনাবারি সেচন করিতে লাগিলেন ও ভগিনী আপন অঞ্চল দিয়া ভ্রাতার চক্ষের জল ও গায়ের ধূলা পুঁছাইয়া দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। এদিকে ঐ বুড়ী বাটীর মধ্যে বাবুকে না পাইয়া তাড়াতাড়ি বাগানে আসিয়া দেখে যে বাবু তাহার সমভিব্যাহারিণী প্রাচীনা স্ত্রীলোকের কোলে মস্তক দিয়া ভূমে শয়ন করিয়া আছেন —ও মা এ কি গো! ওগো বাবুর কি ব্যারাম হয়েছে? আমি কি কবিরাজ ডেকে আনব? বুড়ী এই বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। বরদাপ্রসাদ বাবু বলিলেন, স্থির হও —বাবুর পীড়া হয় নাই, এই যে দুইটি স্ত্রীলোক —এঁরা বাবুর মা ও ভগিনী। বুড়ী উত্তর করিল —বাবু! দুঃখী বলে কি ঠাট্টা করতে হয়? বাবু হলেন লক্ষপতি, আর এঁরা হল পথের কাঙ্গালিনী —আমার সঙ্গে এসে কেও হলেন মা, কেও হলেন বোন— বোধ হয় এরা কামীখ্যার মেয়ে —ভেল্কিতে ভুলিয়েছে— বাবা! এমন মেয়েমানুষ কখন দেখি না —এদের জাদুকে গড় করি মা! বুড়ী এইরূপ বকতে২ ত্যক্ত হইয়া চলিয়া গেল।

 এখানে সকলে সুস্থির হইয়া বাটী আগমন করিলেন, তথায় পুত্রবধূকে ও সপত্নীকে দেখিয়া মাতার পরম সন্তোষ হইল, পরে আপনার আর২ পরিবারের কথা অবগত হইয়া বলিলেন, বাবা রাম! চল, বাটী যাই —আমার মতি কোথায় —তার জন্য মন বড় অস্থির হইতেছে। রামলাল পূর্ব্বেই বাটী যাওনের উদ্‌যোগ করিয়াছিলেন —নৌকাদি ঘাটে প্রস্তুত ছিল। মাতার আজ্ঞানুসারে উত্তম দিন দেখিয়া সকলকে লইয়া যাত্রা করিলেন —যাত্রাকালীন মথুরার যাবতীয় লোক ভেঙ্গে পড়িল —সহস্র২ চক্ষু বারিতে পরিপূর্ণ হইল —সহস্র২ কর তাঁহার আশীর্ব্বাদার্থ উত্থিত হইল। যে বুড়ী বিরক্ত হইয়াছিল সে জোড়হাত করিয়া রামলালের মাতার নিকট আসিয়া কাঁদিতে লাগিল, নৌকযে পর্যন্ত দৃষ্টিপথ অতিক্রম না করিল সে পর্যন্ত সকলে যমুনার তীরে যেন প্রাণশূন্য দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।

 এদিকে একটানা —দক্ষিণে বায়ুর সঞ্চার নাই —নৌকা স্রোতের জোরে বেগে চলিয়া অল্প দিনের মধ্যেই বারাণসীতে আসিয়া উত্তীর্ণ হইল। বারাণসীর মধ্যে প্রাতঃকালীন কিবা শোভা! কত২ দোবেদী, চৌবেদী, রামাৎ, নেমাৎ, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, পরমহংস ও ব্রহ্মচারী স্তোত্র পাঠ করিতেছেন —কত২ সামবেদী কঠ কৌথুমাদির মন্ত্র ও অগ্নি বায়ুর সূক্ত উচ্চারণ করিতেছেন —কত২ সুরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, বঙ্গ ও মগধস্থ নানাবর্ণ পট্ট বস্ত্র পরিধারিণী নারীরা স্নাত হইয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছে —কত২ দেবালয় ধূপ, ধূনা, পুষ্প, চন্দনের সৌগন্ধে আমোদিত হইতেছে —কত২ ভক্ত “হর২ বিশ্বেশ্বর” শব্দ করতঃ গাল ও কক্ষবাদ্য করিয়া উন্মত্ত হইয়া চলিয়াছে —কত২ রক্তবসনা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী অট্ট২ হাস্য করত ভৈরবালয়ে ভৈরব ভাবিনী ভাবে ভ্রমণ করিতেছে —কত২ সন্ন্যাসী, উদাসীন ও ঊর্দ্ধবাহু জটাজুট সংযুক্ত ও ভস্ম বিভূতি আবৃত হইয়া শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি নিগ্রহে সযত্ন আছেন —কত২ যোগী নিজ২ বিরল স্থানে সমাধি জন্য রেচক, পূরক ও কুম্ভক করিতেছেন —কত২ কলায়ত, ধাড়ি ও আতাই বীণা, মৃদঙ্গ, রবাব ও তানপুরা লইয়া ধ্রুপদ, ধরু, খেয়াল প্রবন্ধ, ছন্দ, সোরবন্ধ, তেরানা, সারগম, চতুরং ও নক্সগুলে মশগুল হইয়া আছে। রামলাল ও অন্যান্য সকলে মণিকর্ণিকার ঘাটে স্নানাদি করিয়া কাশীতে চারি দিবস অবস্থিতি করিলেন। রামলাল মায়ের ও ভগিনীর নিকট সর্ব্বদা থাকিতেন, বৈকালে বরদাবাবুকে লইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেন। এক দিন পর্য্যটন করিতে২ দেখিলেন সম্মুখে একটি মনোরম আশ্রম, সেখানে এক প্রাচীন ব্যক্তি বসিয়া ভাগীরথীর শোভা দেখিতেছেন— নদী বেগবতী —বারি তর্২ শব্দের চলিয়াছে —আপনার নির্ম্মলত্ব হেতুক বৈকালিক বিচিত্র আকাশকে যেন ক্রোড়ে লইয়া যাইতেছে। রামলাল ঐ ব্যক্তির নিকট যাইবামাত্রে তিনি পূর্ব্বপরিচিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন —কেমন শুকোপনিষৎ পাঠে তোমার কি বোধ হইল? রামলাল তাঁহার মুখাবলোকন করণানন্তর প্রণাম করিলেন। সেই প্রাচীন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন —বাবা! আমার ভ্রম হইয়াছে —আমার একজন শিষ্য আছে তাহার মুখ ঠিক তোমার মত, আমি তাহাকেই বোধ করিয়া তোমাকে সম্বোধন করিয়াছিলাম। পরে রামলালবরদাবাবু তাঁহার নিকট বসিয়া নানা প্রকার শাস্ত্রীয় আলাপ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে চিন্তাযুক্ত এক ব্যক্তি অধোবদনে নিকটে আসিয়া বসিলেন। বরদা বাবু তাঁহাকে নিরীক্ষণ করত বলিলেন —রাম! দেখ কি?—নিকটে যে তোমার দাদা! রামলাল এই কথা শুনিবামাত্রে লোমাঞ্চিত হইয়া মতিলালের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, মতিলাল রামলালকে অবলোকনপূর্ব্বক চমকিয়া উঠিয়া আলিঙ্গন করিলেন। ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া —“ভাই হে! আমাকে কি ক্ষমা করিবে”—মতিলাল এই কথা বলিয়া অনুজের গলায় হাত জড়াইয়া স্কন্ধদেশ নয়নবারিতে অভিষিক্ত করিলেন। দুইজনেই কিয়াৎক্ষণ মৌন ভাবে থাকিলেন —মুখ হইতে কথা নিঃসরণ হয় না —ভাই যে কি পদার্থ তাহা উভয়েরই ঐ সময়ে বিলক্ষণ বোধ হইল। পরে বরদা বাবুর চরণধূলা লইয়া মতিলাল জোড় হাতে বলিলেন —মহাশয়! আপনি যে কি বস্তু তাহা আমি এত দিনের পর জানিলাম —এ নরাধমকে ক্ষমা করুন। বরদাবাবু দুই ভ্রাতার হাত ধরিয়া উক্ত প্রাচীন ব্যক্তির নিকট হইতে বিদায় লইয়া পথিমধ্যে তাহাদিগের পরস্পরের যাবতীয় পূর্ব্ব কথা শুনিতে২ ও বলিতে২ চলিলেন এবং আলাপ দ্বারা মতিলালের চিত্তের বিভিন্নতা দেখিয়া অসীম আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন। পরিবারেরা যে স্থানে ছিলেন, তথায় আসিলে মতিলাল কিঞ্চিৎ দূর থেকে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন —“কই মা কোথায়? —মা! তোমার সেই কুসন্তান আবার এল —সে আজো বেঁচে আছে —মরে নাই —আমি যে ব্যবহার করিয়াছি তার পর যে তোমার নিকট মুখ দেখাই এমন ইচ্ছা করে না —এক্ষণে আমার বাসনা এই যে একবার তোমার চরণ দর্শন করিয়া প্রাণ ত্যাগ করি।” মাতা এই কথা শুনিবা মাত্রে প্রফুল্লচিত্তে অশ্রুযুক্ত নয়নে নিকটে আসিয়া জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখাবলোকনে অমূল্য ধন প্রাপ্ত হইলেন। মতিলাল মাতাকে দেখিবা মাত্রেই তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া পড়িয়া থাকিলেন। ক্ষণেক কাল পরে মাতা হাত ধরিয়া উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষের জল পুছাইয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন —মতি! তোমার বিমাতা, ভগিনী ও স্ত্রী আছেন তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ কর। মতিলাল ভগিনী ও বিমাতাকে প্রণাম করিয়া আপন পত্নীকে দেখিয়া পূর্ব্বকথা স্মরণ হওয়াতে রোদন করিয়া বলিলেন —মা! আমি যেমন কুপুত্র, কুভ্রাতা, তেমনি কুস্বামী —এমন সৎস্ত্রীর যোগ্য আমি কোনো প্রকারেই নহি! স্ত্রী-পুরুষ বিবাহকালীন পরমেশ্বরের নিকট এক প্রকার শপথ করে যে তাহার যাবজ্জীবন পরস্পর প্রেম করিবে, মহাক্লেশে পড়িলেও ছাড়াছাড়ি হইবে না —স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি মন কখন হইবে না এবং পুরুষেরও অন্য স্ত্রীর প্রতি মন কদাপি যাইবে না —ঐরূপ মননে ঘোর পাপ। এই শপথের বিপরীত কর্ম্ম আমা হইতে অনেক হইয়াছে তবে স্ত্রী কর্ত্তৃক আমি পরিত্যক্ত কেন না হই? আর আমার এমন যে ভাই ও ভগিনী তাহাদিগের প্রতি যৎপরোনাস্তি নিগ্রহ করিয়াছি —তুমি যে মা —যার বাড়া পৃথিবীতে অমূল্য বস্তু আর নাই —তোমাকে অসীম ক্লেশ দিয়াছি —পুত্র হইয়া তোমাকে প্রহার করিয়াছি। মা! এ সকল পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে? এক্ষণে আমার শীঘ্র মৃত্যু হইলে মনে যে দাবানাল জ্বলিতেছে তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাই, কিন্তু বোধ করি মৃত্যুর মৃত্যু হইয়াছে কারণ তাহার দূতস্বরূপ রোগের কিছু চিহ্ণ দেখি না —যাহা হউক তোমরা সকলে বাটী যাও —আমি এই ধামে গুরুর নিকট থাকিয়া কঠোর অভ্যাসে প্রাণ ত্যাগ করিব।

 অনন্তর বরদা বাবু, রামলাল ও তাহার মাতা মতিলালের গুরুকে আনাইয়া বিস্তর বুঝাইয়া মতিলালকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। মুঙ্গেরের নিকট রজনীযোগে নৌকা চাপা হইলে চৌয়াড়ের মতো আকৃতি একজন লোক ঘনিয়া২ কাছে আসিয়া “আগুন আছে —আগুন আছে” বলিয়া উঁচু হইয়া দেখিতে লাগিল। তাহার রকম-সকম দেখিয়া বরদা বাবু বলিলেন —সকলে সতর্ক হও, তদনন্তর নৌকার ছাতের উপর উঠিয়া দেখিলেন একটা ঝোপের ভিতরে প্রায় বিশ —ত্রিশজন অস্ত্রধারী লোক ঘাপ্টি মারিয়া বসিয়া আছে —ঐ ব্যক্তি সংকেত করিলে চড়াও হইবে। অমনি রামলাল ও বরদা বাবু বাহির হইয়া বন্দুক লইয়া আওয়াজ করিতে লাগিলেন, বন্দুকের আওয়াজে ডাকাইতেরা বনের ভিতর প্রবেশ করিল। বরদা ও রামলালের মানস যে তলওয়ার হাতে লইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ২ গিয়া দুই একজনকে ধরিয়া আনিয়া নিকটস্থ দারোগার জিম্মা করিয়া দেন কিন্তু পরিবারেরা সকলে নিষেধ করিল। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া বলিল —আমার বাল্যাবস্থা অবধি সর্ব্ব প্রকারেই কুশিক্ষা হইয়াছে —আমার বাবুয়ানাতেই সর্ব্বনাশ হইয়াছে। রামলাল কসলৎ করিত তাহাতে আমি পরিহাস করিতাম —কিন্তু আজ জানিলাম যে বালককালাবধি মর্দানা কসলৎ না করিলে সাহস হয় না। সম্প্রতি আমার অতিশয় ভয় হইয়াছিল, যদ্যপি রামলাল ও বরদা বাবু না থাকিতেন তবে আমরা সকলেই কাটা যাইতাম।

 অল্পকালের মধ্যে সকলে বৈদ্যবাটীতে পৌঁহুছিয়া বরদা বাবুর বাটীতে উঠিলেন। বরদা বাবু ও রামলালের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া গ্রামস্থ যাবতীয় লোক চতুর্দ্দিক্ থেকে দেখা করিতে আসিল —সকলেরই মনে আনন্দের উদয় হইল —সকলেরই বদন আহ্লাদে দেদীপ্যমান হইল —সকলেই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইয়া প্রার্থনা ও আশীর্ব্বাদের পুষ্প বৃষ্টি করিতে লাগিল।

 হেরম্বচন্দ্র চৌধুরী বাবু পর দিবস আসিয়া বলিলেন —রামবাবু! আমি বুঝিতে পারি নাই —বাঞ্ছারামের পরামর্শে তোমাদিগের ভদ্রাসন দখল করিয়া লইয়াছি —আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি যে তোমাদিগের পরিবারকে বাহির করিয়া বাটী দখল লইয়াছি। তোমার অসাধারণ গুণ —এক্ষণে আমি বাটী অমনি ফিরিয়া দিতেছি, আপনারা স্বচ্ছন্দে সেখানে গিয়া বাস করুন। রামলাল বলিলেন —আপনার নিকট আমি বড় উপকৃত হইলাম, যদ্যপি আপনার বাটী ফিরিয়া দিবার মানষ হয় তবে আপনার যাহা যথার্থ পাওনা আছে গ্রহণ করিলে আমরা বাধিত হইব। হেরম্ববাবু এই প্রস্তাবে সম্মত হইলে রামলাল তৎক্ষণাৎ নিজে হইতে টাকা দিয়া দুই ভায়ের নামে কওয়ালা লিখিয়া লইয়া পরিবারের সহিত পৈতৃক ভদ্রাসনে গেলেন এবং ঊর্দ্ধদৃষ্টি করত কৃতজ্ঞচিত্তে মনে২ বলিলেন —“জগদীশ্বর! তোমা হইতে কি না হইতে পারে!”

 অনন্তর রামলালের বিবাহ হইল ও দুই ভাইয়ে অতিশয় সম্প্রীতে মায়ের ও অন্যান্য পরিবারের সুখবর্দ্ধক হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। বরদা বাবু বরদাপ্রসাদাৎ বদরগঞ্জে বিষয় কর্ম্মার্থ গমন করিলেন —বেচারাম বাবু বিষয় বিভব বিক্রয় করিয়া প্রকৃত বেচারাম হইয়া বারাণসীতে বাস করিলেন —বেণী বাবু কিছু দিন বিনা শিক্ষায় সৌখিন হইয়া আইন ব্যবসাতে মনোযোগ করিলেন —বাঞ্ছারাম বহুৎ ফন্দি ও ফেরেক্কা করিয়া বজ্রাঘাতে মরিয়া গেলেন —বক্রেশ্বর খোসামোদ ও বরামদ করিয়া ফ্যা২ করত বেড়াইতে লাগিলেন –ঠকচাচা ও বাহুল্য পুলিপালমে গিয়া জাল করাতে সেখানে তাহাদিগের বাজিঞ্জির মাটি কাটিতে হয় এবং কিছুদিন পরে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইয়া তাহাদের মৃত্যু হইল –ঠকচাচী কোন উপায় না দেখিয়া চুড়িওয়ালী হইয়া ভেটিয়ারি গান “চুড়িয়ালের চুড়িয়া” গাইতে২ গলি২ ফিরিতে লাগিলেন—হলধর, গদাধর ও আর২ ব্রজবালক মতিলালের স্বভাব ভিন্ন দেখিয়া অন্যান্য কাপ্‌তেন বাবুর অন্বেষণ করিতে উদ্যত হইল –জান সাহেব ইনসালবেণ্ট লইয়া দালালি কর্ম্ম আরম্ভ করিলেন –প্রেমনারায়ণ মজুমদার ভেক লইয়া “মহাদেবের মনের কথা রে অরে ভক্ত বই আর কে জানে” এই বলিয়া চীৎকার করিয়া নবদ্বীপে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন –প্রমদার স্বামী অনেক স্থানে পাণি গ্রহণ করিয়া ছিলেন, এক্ষণে শূন্য পাণি হওয়াতে বৈদ্যবাটীতে আসিয়া শ্যালকদিগের স্কন্ধে ভোগ করত কেবল কলাইকন্দ, ঘেয়ারূ, তাজফেনি, বেদানা, সেও ও জলগোজা খাইয়া টপ্পা মারিতে আরম্ভ করিলেন—তাহার পরে যে সকল ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতে বাকী রহিল —“আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল”———